গঙ্গা দিয়ে জল বয়ে যায়। বিটি রোড ধরে চলতে থাকে মানুষের সারি। তার মধ্যেই আর আপাত নিস্তরঙ্গ জনপদকে ঝাপটা মেরে যায় অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং সেই মৃত্যু ঘিরে আলোড়ন। টানাপড়েন।
জনপদের নাম পানিহাটি।
ব্যবধান ১৪ মাসের। ২০২৪ সালের অগস্টে যে জনপদ ঘিরে আলোড়িত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক জীবন, ২০২৫ সালের অক্টোবরের সায়াহ্নে কলকাতা লাগোয়া সেই জনপদ ঘিরেই আবার তপ্ত হচ্ছে রাজ্যের রাজনীতি। ১৪ মাস আগে যে জনপদকে ঘিরে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল শাসক তৃণমূলকে, এখন সেই জনপদকেই এসআইআর এবং তজ্জনিত ‘আতঙ্কের’ বিরুদ্ধে আন্দোলনের ‘ভরকেন্দ্র’ করতে চাইছে তারা। ১৪ মাস আগে আরজি করে ধর্ষিতা নিহত তরুণী চিকিৎসকের বাড়ি ছিল এই জনপদেই। কাকতালীয় ভাবে, ‘এসআইআর আতঙ্কে আত্মঘাতী’ প্রদীপ করও এই জনপদেরই বাসিন্দা।
আরজি কর আন্দোলনের সময়ে স্লোগান ছিল ‘সারা বাংলার একটাই স্বর, জাস্টিস ফর আরজি কর’। সেই ধাঁচেই আত্মঘাতী প্রদীপের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্লোগান দিয়েছেন, ‘সারা বাংলার একটাই স্বর, জাস্টিস ফর প্রদীপ কর’।
আরজি করের পাল্টা প্রদীপ কর! পানিহাটির পাল্টা পানিহাটি!
পানিহাটির পানশিলা এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী উত্তম সরকারের কথায়, ‘‘এ শহরের অনেক গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে যে দু’টি ঘটনাকে ঘিরে পানিহাটি জনমানসে এত আলোচনার মধ্যে এল, তা কাঙ্ক্ষিত ছিল না।’’
প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের প্রাচীন পানিহাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। যে ইতিহাসে জুড়ে আছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু থেকে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশ দাশগুপ্তদের নাম। ৫২৪ বছর আগে যখন জাতপাতের বিভাজনে দীর্ণ সমাজ, তখনই শান্তিপুর থেকে পুরী যাওয়ার পথে পানিহাটিতে এসে পৌঁছেছিলেন শ্রীচৈতন্য। তাঁর আসার আগেই অবশ্য গঙ্গাপারের এই শহরে বৈষ্ণব ভাবধারা বিরাজ করতে শুরু করেছিল। গুরুত্ব অনুধাবন করেই নিজের দুই বিশ্বস্ত অনুচরকে দু’টি জনপদে পাঠিয়েছিলেন চৈতন্য। অদ্বৈত গোস্বামী গিয়েছিলেন শান্তিপুরে আর পানিহাটিতে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু।
সংসার ত্যাগ করে হুগলির এক জমিদারপুত্র শ্রীচৈতন্যের আশীর্বাদ নিতে পৌঁছেছিলেন পানিহাটিতে। তত ক্ষণে অবশ্য পুরীর উদ্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছেন চৈতন্য। কিন্তু তাঁর সমাজদর্শনকে আরও গভীরে প্রোথিত করতে সেই জমিদারপুত্রের মাধ্যমে কলকাতা লাগোয়া এলাকায় প্রথম সামাজিক বিপ্লবটি ঘটিয়ে ফেলেছিলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। জমিদারপুত্রকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, জৈষ্ঠের সেই প্রবল দাবদাহের সময়ে ভক্তদের মধ্যাহ্নভোজ করাতে হবে। কারণ, তিনি বিত্তবান। জমিদারপুত্র রাজি হয়ে যান। ভক্তদের খাওয়ানো হয় দই-চিঁড়ে। ১৬ জাতের লোক একসঙ্গে পাত পেড়ে খেয়েছিলেন মধ্যাহ্নভোজ। ভেঙে গিয়েছিল জাতপাতের বেড়া। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে এখনও পানিহাটিতে ‘চিঁড়ে’ উৎসবে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে। যার শুরু হয়েছিল ৫০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। শ্রীচৈতন্যের দর্শনে।
১৮৭৩ সালে গোটা কলকাতায় জ্বরের প্রকোপ। সম্ভ্রান্তেরা শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। যেমন গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সকলে। উঠেছিলেন এই পানিহাটিতে গঙ্গার ধারে ছাতুবাবুর বাগানবাড়িতে। ছিলেন তখন বছর বারোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। টানা কয়েক মাস সেই বাগানবাড়ি হয়ে উঠেছিল ‘ঠাকুরবাড়ি’। এই পানিহাটিতেই গঙ্গার ধারে একটি বাগানওয়ালা বাড়ি কিনেছিলেন সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের মামা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বেশ কিছুটা সময়ে লীলা ছিলেন মামার বাড়িতে। সেখান থেকেই বরাহনগরের স্কুলে যাতায়াত করতেন কিশোরী। পরে ছোটগল্প ‘পেনেটিতে’ লীলা গঙ্গার ধারের সেই বাড়িটিতে ভূতের আতঙ্কের কথা লিখেছিলেন। কৈশোরের রবীন্দ্রনাথকে কি তেমন কোনও ভূত-টুতের উৎপাতের মুখে পড়তে হয়েছিল গঙ্গার ধারের অন্য বাগানবাড়িটিতে? তেমন কোনও প্রামাণ্য দস্তাবেজ অবশ্য পাওয়া যায়নি।
শুধু কৈশোর নয়। রবীন্দ্রনাথ আবার আসিবেন ফিরে পেনেটিতে। তাঁর প্রৌঢ়ত্বে। সিদ্ধান্ত নিতে। যে সিদ্ধান্ত ইতিহাস হয়ে যাবে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে গণহত্যা চালিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকের বাহিনী। যে ঘটনা অস্থির করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তার ছ’বছর আগে তিনি নোবেল পেয়েছেন। প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ ছুটে বেড়াচ্ছেন গান্ধী থেকে চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। প্রতিবাদ প্রয়োজন। কী করবেন? দিশা না পেয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সেই পানিহাটিতে। গঙ্গার ধারে একটি বাড়িতে উঠলেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত নিলেন। কলকাতায় ফিরে চিঠি লিখে প্রত্যাখ্যান করলেন ব্রিটিশের দেওয়া ‘নাইটহুড’।
১৯২৪ সালে আর এক ইতিহাসের সাক্ষী হল পানিহাটি। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তৈরি ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল্স’ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন কেমিস্ট সতীশ দাশগুপ্ত। বেঙ্গল কেমিক্যালসে সতীশ এবং রাজশেখর বসু ছিলেন জুটি। পানিহাটিতে এসে সতীশ তৈরি করলেন খাদি প্রতিষ্ঠান। কেমিস্ট থেকে হয়ে উঠলেন কুটিরশিল্পের ধারক। ক্রমে সেই খাদি ডালপালা মেলল আশপাশের জেলায়। ১৯২৭ থেকে ১৯৪৭— এই দুই দশকে পানিহাটিরই সোদপুর স্টেশন লাগোয়া খাদি ভবনে দফায় দফায় কাটিয়েছেন গান্ধী। যে খাদি ভবনকে নিজের ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন তিনি স্বয়ং। কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনের পরে যখন গান্ধী-সুভাষ ‘দ্বন্দ্ব’ ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে, সেই পর্বে ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে টানা চার দিন সোদপুরের খাদি ভবনে ‘মীমাংসা বৈঠক’ বসেছিল। যেখানে হাজির ছিলেন গান্ধী, সুভাষ, জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদেরা। কিন্তু মীমাংসা হয়নি। চতুর্থ দিন খাদি ভবনের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে একটি মুখবন্ধ খাম দেখিয়ে সুভাষ জানিয়েছিলেন, সিদ্ধান্ত ওই খামে রয়েছে। তার পরে কলকাতায় ফিরে ওয়েলিংটন স্কোয়্যার থেকে কংগ্রেস ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র।
পরবর্তী কালে ১৯৫৯ এবং ১৯৬৬ সালে দুই পর্বের খাদ্য আন্দোলনেই আলোড়িত হয়েছিল পানিহাটি। মাঝে কেটে গিয়েছে আরও ছ’টি দশক। পানিহাটি ক্রমে ‘শহর’ হয়ে উঠেছে। বিটি রোডের পাশে অগণিত কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ কারখানার জমিতে মাথা তুলেছে বহুতল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে রাজনীতির সমীকরণও। সিপিএমের প্রতাপ ভেঙে এখন সেখানে তৃণমূলের প্রভাব। বৈষ্ণব ভাবধারার জনপদে নিশ্চুপে ইমারত গড়েছে প্রোমোটার রাজ। আগরপাড়ার বাসিন্দা রঞ্জিতা রায়চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘এখানে আমরা নানা বেশে নানা দলের রাবণকে প্রত্যক্ষ করেছি এবং করছি। কিন্তু কখনও ভাবিনি এই এলাকাকে ঘিরেই পর পর এমন ঘটনা ঘটবে।’’
গঙ্গা দিয়ে জল বয়ে গিয়েছে। বিটি রোড ধরে চলে গিয়েছে মানুষের সারি। ১৪ মাসের ব্যবধানে উপর্যুপরি আবার আলোড়িত আপাত নিস্তরঙ্গ সেই জনপদ। পানিহাটি।