Advertisement
E-Paper

শাস্তির দাবির মাঝেই ছোট ঘটনার তকমা

দিদির দরবারে মাফ! কিন্তু সংসদে তাপস পালের শাস্তি চেয়ে দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।তাপস খোলা ময়দানে দাঁড়িয়ে যতই উস্কানিমূলক, অশালীন কথা বলুন, ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিতেই যে তাঁর সাত খুন মাফ করে দেওয়া হবে, সেটা মঙ্গলবারই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার দলেই বৈঠকে সেই চিত্রনাট্য মেনেই পার পেয়ে গিয়েছেন তাপস। বৃহস্পতিবারও নজরুল মঞ্চে এক অনুষ্ঠানে নাম না-করেই তাপস পালের মন্তব্যকে প্রকারান্তরে ছোট ঘটনা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৪ ০৩:৪৫

দিদির দরবারে মাফ! কিন্তু সংসদে তাপস পালের শাস্তি চেয়ে দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।

তাপস খোলা ময়দানে দাঁড়িয়ে যতই উস্কানিমূলক, অশালীন কথা বলুন, ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিতেই যে তাঁর সাত খুন মাফ করে দেওয়া হবে, সেটা মঙ্গলবারই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার দলেই বৈঠকে সেই চিত্রনাট্য মেনেই পার পেয়ে গিয়েছেন তাপস। বৃহস্পতিবারও নজরুল মঞ্চে এক অনুষ্ঠানে নাম না-করেই তাপস পালের মন্তব্যকে প্রকারান্তরে ছোট ঘটনা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

তবে তৃণমূল সাংসদের প্রতি রাজ্য সরকারের দৃষ্টি যতই ক্ষমাশীল হোক না কেন, সংসদ কিন্তু ততটা উদার না-ও হতে পারে। তাপসের সাংসদ পদ খারিজ করার দাবিতে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে জাতীয় মহিলা কমিশন, বাম দল-সহ বিভিন্ন মহল। লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল পি ডি টি আচারি বলেন, “তৃণমূলের ওই সাংসদ কু-কথার যে নজির সৃষ্টি করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সংসদের। প্রয়োজনে তাপসকে বহিষ্কার করা হোক। এই দৃষ্টান্তমূলক কড়া পদক্ষেপ নিলে অন্যান্য দলের সাংসদরাও ভবিষ্যতে প্রকাশ্যে এই ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন।”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাপসের ক্ষেত্রে কি সত্যিই এ রকম কড়া পদক্ষেপ করতে পারে সংসদ? আচারি বলছেন, “পারে। নির্বাচন কমিশনের হাতে কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার নেই। ভারতের নির্বাচনী আইনেও কোনও সাংসদকে ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার (রাইট টু রিকল) দেওয়া হয়নি ভোটারকে। সংসদের হাতে কিন্তু সেই অধিকার রয়েছে।” দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের একেবারে শেষ পর্বে সংসদে তেলেঙ্গানার পক্ষে ও বিপক্ষে থাকা সাংসদদের অশোভন আচরণের অপরাধে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। আচারির বক্তব্য, “তাপসের ক্ষেত্রে আরও কড়া পদক্ষেপ নিয়ে তাঁর সদস্যপদই খারিজ করে দিক সংসদ!” ইউপিএ-১ জমানায় স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আমলে ‘ক্যাশ ফর ভোট’ কাণ্ডে কিছু সাংসদকে যখন বরখাস্ত করা হয়, তখন লোকসভার সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন আচারিই।

তাপসের বিরুদ্ধে সংসদে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে বাম-সহ বিভিন্ন দলের নেতৃত্ব যখন সরব, তখন তাঁকে আড়াল করতে সক্রিয় তৃণমূলনেত্রী। মঙ্গলবার তাপসকে ক্ষমা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কি ওকে খুন করব?’ এ দিন নজরুল মঞ্চে এক অনুষ্ঠানে সরাসরি তাপসের প্রসঙ্গ না তুললেও সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, “কখনও কখনও বিষ গিলতে হয়। এখন তো ভাল কাজে নামই হয় না! ‘প্ল্যান্টেড ওয়ে’-তে (পরিকল্পনামাফিক) কুৎসা-অপপ্রচার করা হচ্ছে। ছোট ঘটনা কিছু একটা হলেও, না হলেও বেরিয়ে পড়ছে রমরম রমরম করে!”

প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে দোষ চাপালেও তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বুঝতে পারছেন, শুধু ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠির ভিত্তিতে তাপসকে দলীয় স্তরে রেহাই দেওয়ার ঘটনা বিতর্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সংসদ খুললে এর জন্য জাতীয় স্তরে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে তৃণমূল। সেই জন্যই তাপসকে সতর্ক করে কোনও পদক্ষেপ করা যায় কি না, দলীয় স্তরে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “ওঁর চিঠি এখনও দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে পাঠানো হয়নি। তবে বিষয়টি আমাদের মাথায় রয়েছে।” দলেরই একটি সূত্রের বক্তব্য, আসন্ন বাজেট অধিবেশনের প্রথম পর্বে অন্তত তাপসকে সংসদ এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। যাতে বিতর্ক থিতিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে কেউ অবশ্য এই নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।

তৃণমূল ওই কৌশল নিতে চাইলেও বামেরা বিষয়টি সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ। তাপসের সাংসদ-পদ খারিজের দাবি নিয়ে এ দিন লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের সঙ্গে দেখা করেন বাম ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক মহিলা সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সিপিএমের সংসদীয় নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এ দিন স্পিকারকে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, ‘তাপস পালের অসদাচরণে সার্বিক ভাবে সংসদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি সংসদের এথিক্স কমিটির কাছে পাঠানো হোক ও তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক’। সংসদ খুলতেই তাপসের বিরুদ্ধে অধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব আনতে চাইছে বাম শিবির। কংগ্রেস ও বিজেপি সেই প্রস্তাবে সামিল হবে বলে ইতিমধ্যেই জানিয়েছে।

এই দাবির মুখে কী করতে পারে সংসদ? স্পিকার তাঁর একার সিদ্ধান্তে কাউকে শাস্তি দিতে পারেন না। কিন্তু যৌথ ভাবে সংসদ তা পারে। এমনকী, সাংসদ-পদ খারিজের মতো কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও রয়েছে সংসদের। আচারির মতে, কোনও সাংসদের আচরণে অধিকার ভঙ্গ হয়েছে, এই অভিযোগ আনতে পারেন অন্য সাংসদরা। কেবল সংসদের মধ্যেই নয়, বাইরেও তাঁর বক্তব্য বা আচরণ যদি সংসদের গরিমাকে ক্ষুণ্ণ করে, সেই যুক্তিতেও ভারতীয় সংসদে অধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব আনা যায়। প্রয়োজনে তদনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে সংসদ। ‘ক্যাশ ফর ভোট’ কাণ্ডের অভিজ্ঞতা থেকে আচারির মন্তব্য, “সেই সময়ে যে ভাবে ওই ব্যক্তিরা সংসদের মধ্যে টাকার গোছা তুলে ধরেছিলেন, তাতে সংসদের গরিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তখন যদি ওই সাংসদদের বিরুদ্ধে শাস্তিবিধান করা হয়ে থাকে, তা হলে তাপসের ক্ষেত্রে কেন হবে না!”

কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি কী হবে? আচারি জানাচ্ছেন, কোনও সাংসদের বিরুদ্ধে অধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব এলে এবং সেই অভিযোগের সারবত্তা থাকলে স্পিকার ব্যক্তিগত ভাবে সেটির তদন্ত করতে পারেন। অথবা গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য অধিকার রক্ষা কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন। সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে অভিযুক্ত সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন স্পিকার। বাম শিবির জানিয়ে দিয়েছে, তারা তাপসের বিরুদ্ধে অধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব আনতে পারে। বামেদের ওই কৌশল ঠেকাতেই তৃণমূলের একটি অংশ চাইছে, শারীরিক অসুস্থতার যুক্তি দেখিয়ে আপাতত অধিবেশন এড়িয়ে চলুন তাপস। তা হলে অধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব এলেও উত্তর দেওয়া আপাতত এড়িয়ে যেতে পারবেন ওই সাংসদ। যদিও সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের দাবি, “একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর না এলে সেটাও সংসদ অবমাননা হিসাবে গণ্য হবে। তখন সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার।”

আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে বাজেট অধিবেশন। সংসদে সব দলের কড়া আক্রমণ ঠেকাতে তাপসকে লোকসভা এড়িয়ে চলতে বলা ছাড়াও আরও একটি কৌশল তৃণমূল নিতে পারে। আচারির কথায়, “দেখা গেল, তাপস যে দিন সংসদে এলেন, সে দিন নিজে থেকেই সর্বসমক্ষে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। যাতে তাঁর বিরুদ্ধে সে ভাবে সরব হতে না পারেন বিরোধী দলের সাংসদেরা।” দলের কাছে চিঠি দেওয়ার পরে সংসদেও তাপস ক্ষমা চাইবেন কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট করা হয়নি তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে। দলকে পাঠানো চিঠিতে তাপস দাবি করেছিলেন ভোটের প্রচারে ওই মন্তব্য করেছিলেন তিনি। ঘটনা হল, ১৪ জুন, ভোটের ফলপ্রকাশের মাসখানেক পরে ওই মন্তব্য করেছিলেন তিনি। সেই অসঙ্গতি নিয়েও এ দিন মুখ খোলেননি তৃণমূল নেতারা।

গোটা এই তাপস-পর্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে সাংসদদের জন্য নির্দিষ্ট আচরণবিধি চালু করার দাবি জানিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপ। তাঁর দাবি, “নাগরিক সমাজ দীর্ঘ সময় ধরে সাংসদদের কী করা উচিত আর কী উচিত নয়, তা নিয়ে সওয়াল করে আসছে। কিন্তু এক একটি ঘটনা ঘটলে কিছু দিন হইচই হয়। তার পরে আবার ঠান্ডা হয়ে যায়!” কাশ্যপের প্রস্তাব, স্পিকার সর্বদল বৈঠক ডাকুন। সেখানে আদর্শ আচরণবিধি তৈরি হোক। কোনও সাংসদ সেই বিধি ভাঙলে তখন অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

tapas pal mamata bandyapadhyay p d t achari
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy