লড়াইটা শুরু হয়েছিল গত বছর ২২ জুলাই। যে রাতে বৃদ্ধ স্বামীকে চোখের সামনে গুলি খেতে দেখলেন।
তার পরে ১৪ মাস ধরে দাঁতে দাঁত চেপে সেই লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। হার মানেননি তিনি। বাড়ির সামনে বোমা পড়েছে। অভিযোগ না তোলার জন্য শুনতে হয়েছে শাসানি। রাতবিরেতে তদন্তের নামে হানা দিয়েছে সিট। একই প্রশ্ন করে করে জেরবার করে তুলেছে তাঁদের জীবন। বুধবার কলকাতা হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরে স্বামীর খুনের ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশা দেখতে শুরু করেছেন সরস্বতী ঘোষ।
মঙ্গলবার গোটা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেননি। বুধবার কাকভোরেই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। তার পর থেকে চোখ ছিল টিভির পর্দায়। বেলা বাড়তেই বাড়িতে সংবাদমাধ্যমের ভিড় জমতে শুরু করছিল। সব মিলিয়ে ধকলটা আর সইছিল না পাড়ুইয়ের বাঁধ নবগ্রামে নিহত সাগর ঘোষের বৃদ্ধা স্ত্রীর। বারবার ছুটে যাচ্ছিলেন স্বামীর ছবির কাছে। পাড়ুই-কাণ্ডের সিট থেকে সিবিআই, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখার পরেই ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রণাম সারলেন। ধীরভাবে বললেন, “আমার নির্দোষ স্বামীকে চোখের সামনে ওরা খুন করেছিল! তার পরে রাজ্য সরকারই সেই খুনের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে দেয়নি। তাদের পুলিশের মদতেই প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা হয়েছে। আমাদের মতো সাধারণ একটা পরিবারকে বারবার হাইকোর্টে ছুটতে হয়েছে। আশা করছি এ বার সুবিচার পাব।”
এর পরেই খোঁজ নিলেন ছেলের। উদ্বিগ্ন মা পুত্রবধূ শিবানী ঘোষকে বললেন, “হৃদয় কখন ফিরবে? আমার যে খুব চিন্তা হচ্ছে!”
শ্বশুরমশাইয়ের খুনের পর থেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হৃদয়বাবুর স্ত্রীও। সে দিন রাতের পর থেকেই বৃদ্ধা শাশুড়ি আর স্বামীর পাশে থেকে প্রতি দিন নতুন করে লড়াইয়ের রসদ জুগিয়ে গিয়েছেন। সে দিন গুলি খেয়ে রান্নাঘরের মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছিলেন সাগরবাবু। সেই মেঝের দিকে তাকিয়েই শিবানীদেবী বললেন, “জানেন, শ্বশুরমশাই নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। বারান্দায় প্রথম গুলিটা খাওয়ার পর টলতে টলতে ওই রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। কিন্তু, পশুগুলো জানলা দিয়ে আরও একটা গুলি চালাল! বাবা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। লুটিয়ে পড়লেন।” আজও সেই দৃশ্যটা তাড়া করে শিবানীদেবীকে। এসপি-র কাছে এফআইআর করার পর থেকে তিনিই একা হাতে সংসার সামলাচ্ছেন। স্বামীকে বারবারই কোর্ট-কাছারি করতে কলকাতায় ছুটতে হয়। মেয়েকে সামলাতে তাই বেয়াই খুন হওয়ার পর সব ফেলে বাঁধ নবগ্রামে ছুটে এসেছেন শিবানীদেবীর বাবা অনিমারঞ্জন পাল ও মা মমতা পাল। তাঁদের কথায়, “কঠিন সময়ে ওঁদের পাশে তো থাকতেই হবে।”
এ ক’দিন কম ঝড় বয়ে যায়নি বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উপরেও। সিবিআই তদন্তের খবর ছড়াতেই শিবানীদেবীরা ঘর ছেড়ে উঠোনে এসে বসেছিলেন। কিন্তু, দোতলার ঘর থেকে একবারও নীচে নামেনি মিনু। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মিনু সাগরবাবুর একমাত্র নাতনি। দিনভর বাড়িতে নানা লোকের আনাগোনা তাকে আরও আতঙ্কিত করেছে। কয়েক ঘণ্টা ধরে ঘরের দরজা বন্ধ করেই বসেছিল। সরস্বতীদেবী বললেন, “উনি (স্বামী) মিনুর সারা ক্ষণের বন্ধু ছিলেন। ওই ছোট্ট মেয়ের যা কিছু বায়না, সব স্বামীই মেটাতেন। বিকেলে চা নিয়ে এই উঠোনে বসেই নাতনির সঙ্গে তাঁর কত গল্প! সেই দাদু চলে যাওয়ার পর অতটুকু মেয়েও চুপ করে গিয়েছে।” বৃদ্ধার আশা, সিবিআই সঠিক ভাবে তদন্ত করে মিনুর দাদুর আসল খুনিদের শাস্তি দেবে।
সাগরবাবুর পরিবারের অভিযোগ ছিল, ঘটনার পরে পাড়ুই থানার পুলিশ সাদা কাগজে জোর করে সই নিয়ে তাঁদের দিয়ে একটা এফআইআর দায়ের করায়। ওই ‘ভুয়ো’ অভিযোগের ভিত্তিতে সাগরবাবুর সম্পর্কিত এক নাতি (ঘটনার সময় সে ছিল একাদশ শ্রেণির ছাত্র)-সহ গ্রামের চার জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ধৃতদের অন্যতম নবকৃষ্ণ রায়, তাঁর দাদা নেপাল রায় এবং নেপালবাবুর ছেলে মানস রায় প্রথম ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। এ দিন নবকৃষ্ণবাবু বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, সাগরবাবুর খুনের সঙ্গে আমাদের পরিবারের কোনও যোগ নেই। প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে পুলিশই নিরপরাধদের ফাঁসিয়েছে। তাই আমরাই প্রথম সিআইডি বা সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছিলাম।” তাঁরই মতো মাঝরাতে হানা দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় সাগরবাবুর নাতিকে ঘর থেকে টানতে টানতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। তাকে অবশ্য নিরপরাধ বলে সম্প্রতি রায়ও দিয়েছে সিউড়ি জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড। এ দিন বাড়িতে তার দেখা না মিললেও, সে দিন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন ছেলেটির ঠাকুমা। বললেন, “যাদের জন্য আমাদের নিষ্পাপ ছেলেটাকে জেল খাটতে হল, সেই পুলিশের বিরুদ্ধে সিবিআই ব্যবস্থা নেবে তো?”
একই প্রশ্ন সাগরবাবুর পরিবারের। শিবানীদেবীর কথায়, “আসল অপরাধীরা এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশকর্মীরা দোষ করল, তারাও বহাল তবিয়তে। ওই প্রভাবশালীদের সিবিআই এ বার গ্রেফতার করুক। ওদের ধরলে আমরা অনেকটাই নিশ্চিন্ত হব।” ২২ জুলাই রাতের পর থেকে বহু দিন রান্নাঘরের মেঝেয় রক্ত জমাট বেঁধেছিল। আর দেওয়ালে গুলির দাগ। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ জোর করে ওই রক্তের দাগ মেঝে থেকে মুছিয়ে দিয়েছিল।
রান্নাঘরের দেওয়ালে গুলির দাগটা কিন্তু আজও বড় টাটকা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy