Advertisement
E-Paper

প্লেটলেটে শুধু নয়, নানা ভাবে থাবা বসায় ডেঙ্গি

বছর পঁচিশের যুবকের ডেঙ্গি ধরা পড়েছিল। চার দিন যমে-মানুষে টানাটানির পরে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হল তাঁর। চিকিৎসক জানাচ্ছেন, ওই যুবকের রক্তে প্লেটলেট তথা অনুচক্রিকার সংখ্যা কখনওই দেড় লক্ষের নীচে নামেনি।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২০

বছর পঁচিশের যুবকের ডেঙ্গি ধরা পড়েছিল। চার দিন যমে-মানুষে টানাটানির পরে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হল তাঁর। চিকিৎসক জানাচ্ছেন, ওই যুবকের রক্তে প্লেটলেট তথা অনুচক্রিকার সংখ্যা কখনওই দেড় লক্ষের নীচে নামেনি। তবু তাঁর মৃত্যু হয়েছে শক সিনড্রোমে। ব্যপারটা কী রকম? ওই চিকিৎসক জানাচ্ছেন, লিভার এনজাইমগুলির অস্বাভাবিক আচরণই ওই মৃত্যুর মূল কারণ।

বাইপাসের ধারে এক হাসপাতালে ৩৫ বছরের এক মহিলার মৃত্যুতে চিকিৎসকরা জানান, সেপসিস-এর জেরেই এই পরিণতি। ডেঙ্গি শক সিনড্রোমের কারণ হিসেবে ওই মহিলার চিকিৎসক জানান, শ্বেতকণিকা ৩০০-র নীচে নেমে গিয়েছিল। ফলে শরীরে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়। সেপসিস-এর কারণ সেটাই। মহিলার প্লেটলেট কখনওই ১ লক্ষ ২৫ হাজারের নীচে নামেনি।

অর্থাৎ, ডেঙ্গিতে যে কেবল প্লেটলেটই ভিলেন, তা নয়। এই রোগে মৃত্যুর পিছনে আরও শারীরবৃত্তীয় কাণ্ড রয়েছে বলে জানাচ্ছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, ডেঙ্গি ভাইরাস শরীরে বিভিন্ন অঙ্গকে আক্রমণ করে। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির শরীরে তার প্রতিক্রিয়াও হয় এক-এক ধরনের। কারও প্লেটলেট কমে যায়, কারও লিভারের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারও বা শ্বেতকণিকার সংখ্যা দ্রুত কমে যায়। কেবল তা-ই নয়, অনেকের ক্ষেত্রে রক্তে অ্যালবুমিন নামের প্রোটিনও কমে যায় দ্রুত। তাতেও সেপসিস হয় রোগীর। শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়।

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা পরজীবী বিজ্ঞানী অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘কোনও ডেঙ্গি রোগীর প্লেটলেট কী হারে কমছে, আমরা কিন্তু শুধু সেটা দেখি না। আমরা অনেকগুলি জৈব রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। প্লেটলেট তার মধ্যে একটা।’’ এমনকী, ডেঙ্গির ক্ষেত্রে প্লেটলেট কমে যাওয়াটাই অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের একমাত্র কারণ নয় বলে জানাচ্ছেন অমিতাভবাবু।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার এক অধ্যাপকের বিশ্লেষণ, ‘‘রক্তের জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় যে সব জৈব-রাসায়ানিক পদার্থের ভূমিকা থাকে, তাদের কারও কারও অস্বাভাবিকতার ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে দেরি হয়। সেগুলি কমে গেলে শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে যায়। সাধারণত ক্ষরণের ২৬ থেকে ৩৪ সেকেন্ডের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করার কথা। কিন্তু রক্ত জমাট বাঁধার জৈব-রাসায়নিকগুলি ঠিক মাত্রায় না থাকলে প্রক্রিয়াটা বিলম্বিত হয়। রক্ত জমাট বাঁধার সময় (‌কোয়াগুলেশন টাইম) যত বাড়ে, তত বেশি রক্ত বেরিয়ে যায়। এক সময় হেমারেজিক শক সিনড্রোম তৈরি হয়। ওই সব ক্ষেত্রে প্লেটলেটের সংখ্যা কিন্তু কোনও প্রভাব ফেলে না।

ওই শারীরবিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, ডেঙ্গিতে শারীরিক অবস্থার অবনতির পিছনে শ্বেতকণিকার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এক জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের রক্তে শ্বেতকণিকার স্বাভাবিক সংখ্যা হল পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলে অনেকের ক্ষেত্রে তা দ্রুত কমতে থাকে। শ্বেতকণিকার সংখ্যা তিন হাজারের নীচে নেমে গেলেই বিশেষ সতর্কতা নেওয়া দরকার। রক্তে কোনও বাইরের জিনিস ঢুকলেই শ্বেতকণিকাগুলি তাদের আক্রমণ করে। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়েই আটকে দেয় শ্বেতকণিকা। স্বাভাবিক ভাবে যে সব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া শরীরের কোনও ক্ষতি পারে না, শ্বেতকণিকা কমে গেলে সেগুলি অত্যধিক সক্রিয় হয়ে যায়। ফলে অন্য সংক্রমণে আক্রান্ত হয় শরীর। পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এটাই সেকেন্ডারি ইনফেকশন। সেকেন্ডারি ইনফেকশনে অনেক সময়েই সেপসিস হয়ে যায়। রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।’’

ডেঙ্গিতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শরীরে জল জমে পেট ফুলে যাচ্ছে। রক্তে অ্যালবুমিন কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানাচ্ছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, অ্যালবুমিন কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়। এ সব ক্ষেত্রে প্লেটলেট পরিমাপ করে রোগের গতিপ্রকৃতি ধরা যায় না। লিভারের কোষগুলি নষ্ট হয়ে গেলেও পেটে জল জমে যেতে পারে। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে লিভারের কোষ নষ্ট হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা থাকে। তাই ডেঙ্গি রোগীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরীক্ষার পাশাপাশি লিভারের কয়েকটি উৎসেচকের পরিমাণও দেখতে বলেন চিকিৎসকরা। ওই উৎসেচকগুলির অস্বাভাবিকতাই বলে দেয় লিভার ঠিক মতো কাজ করছে কি না। লিভারের কাজ খুব বেশি ব্যাহত হলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

প্লেটেলেটর কমা-বাড়া নিয়ে তবে এত কেন উদ্বেগ? পরজীবী বিজ্ঞানী অমিতাভ নন্দীর ব্যাখ্যা, ‘‘যেহেতু প্লেটলেট কমে গেলে রক্ত দেওয়ার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন দেখা দেয়, তাই রোগীর আত্মীয়েরা প্লেটলেট কমার বিষয়টিকে এত বেশি গুরুত্ব দেন।’’

dengue platelets
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy