গুলি-বোমার এই বিপজ্জনক দাপটের জন্য সরাসরি তর্জনী উঠছে পুলিশেরই দিকে। প্রতীকী ছবি।
আজ পশ্চিম মেদিনীপুরে বোমাবাজি তো কাল উত্তর ২৪ পরগনায় গুলিতে খুন। পরশু বীরভূমে তাজা বোমা উদ্ধার তো তার পরের দিন বিস্ফোরক মিলছে মুর্শিদাবাদে। কী করছে পুলিশ? প্রশ্নটা আমজনতার বৃত্তে আটকে নেই আর। এটা পুলিশেরই প্রাক্তন ও বর্তমান কর্তা-কর্মীদেরও একাংশের প্রশ্ন হয়ে উঠেছে অনেকটা আত্মসমীক্ষণের ধাঁচেই। গুলি-বোমার এই বিপজ্জনক দাপটের জন্য সরাসরি তাঁদের তর্জনী উঠছে পুলিশেরই দিকে। পুলিশি ব্যর্থতায় তাঁরা যেমন ব্যথিত, একই ভাবে তাঁদের বক্তব্য, বাহিনীর মর্যাদা উদ্ধারের দায়িত্ব পুলিশেরই।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দফায় দফায়, বিশেষত বীরভূমের বগটুই গ্রামের বাড়ির পর বাড়িতে আগুন দিয়ে বেশ কয়েক জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনার পরে জেলায় গিয়ে পুলিশকর্তাদের নির্দেশ দেন, রাজ্যের যেখানে যত বেআইনি বোমা-গুলি-বন্দুক রয়েছে, তা অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বছর ঘুরতে চলল, কিন্তু গুলি-বোমার ঘটনায় ভাটা পড়া তো দূরের কথা, উল্টে তা বেড়েই চলেছে। শনিবার কোচবিহারের দিনহাটায় বোমবাজির সামনে পড়তে হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিককে। পুলিশের সামনেই তাঁর গাড়ি ঘিরে বোমাবাজি হয়েছে বলে অভিযোগ।
গত কয়েক দিনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গুলি করে খুন করা হয়েছে চার জনকে। গুলি চালানোর দু’টি ঘটনা ঘটেছে উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড় ও রহড়ায়। তাতে জখম হন কয়েক জন। সম্প্রতি বীরভূমের বিভিন্ন জায়গায়, রাজ্যের অন্যত্রও বোমাবাজি হয়েছে। বোমা উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন প্রান্তে।
গত কয়েক দিনের খুনের ঘটনায় সার্বিক ভাবে পুলিশি ব্যর্থতার ছবিই প্রকট হচ্ছে বলে পুলিশের একাংশের অভিমত। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। ফলে এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্য পুলিশের বিভিন্ন শীর্ষ কর্তা। এই হাল হল কেন? এর পিছনে পুলিশের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিচ্ছেন বিভিন্ন পুলিশকর্তা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশকর্তাদের মতে, অস্ত্র সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। তা যে পড়শি রাজ্য থেকে সহজেই বঙ্গে আসছে, তার তথ্যসমৃদ্ধ খবর দিয়েছে আনন্দবাজারও। প্রশ্ন উঠছে রাজ্যের সীমানায় তল্লাশি ও নজরদারি নিয়ে।
গুলি চালানো, বোমা ছোড়ার মতো যত আগ্নেয় ঘটনা ঘটছে, তার জন্য কি শুধু বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের মতো বিরোধী দল দায়ী, প্রশ্ন তুলছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা নজরুল ইসলাম। তাঁর কথায়, “যদি সেটাই ধরে নিই, তবে তো এটা পুলিশের সাংঘাতিক ব্যর্থতা, যার দায়ভার কোথাও না কোথাও গিয়ে পুলিশমন্ত্রীর উপরেও বর্তায়। আর তা যদি না-হয়, তা হলে ধরতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসই দায়ী।” কেশপুর থেকে জগদ্দল, আসানসোল থেকে মুর্শিদাবাদে বোমা ও গুলির ঘটনা যে-ভাবে ঘটেছে বা ঘটে চলেছে, পুলিশের ব্যর্থতাকেই তার প্রধান কারণ খাড়া করছেন নজরুল।
বর্তমান পুলিশকর্তাদের একাংশের দাবি, এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বড়সড় ব্যর্থতা। তাঁদের মতে, মানুষের সঙ্গে পুলিশের জনসংযোগের অভাবে সমস্যা তৈরি হয়েছে। দুষ্কৃতীদের ধরতে যে-সব ‘সোর্স’ লাগে, তার অভাব প্রকট। রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন আইজি পঙ্কজ দত্ত বলেন, “সন্ত্রাস ঠেকাতে পুলিশের আগাম যা যা করণীয়, তার কিছুই ঠিকঠাক করা হচ্ছে না। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করতে হলে পুলিশের সব বিভাগকে একত্রে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে হবে।’’
অভিযোগ, পুলিশ সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক নেতা-নির্ভর হয়ে পড়ছে। দুষ্কৃতীদের একাংশ সব জমানাতেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকে বলে অভিযোগ। তদুপরি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের একাংশ কার্যত শাসক দলের দাক্ষিণ্যভোগী হয়ে পড়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত কিছু পুলিশকর্তার পর্যবেক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ‘প্রিভেন্টিভ অ্যারেস্ট’ বা গন্ডগোলের সম্ভাবনা আঁচ করে আগাম গ্রেফতারের ধারণাটাই ভুলে গিয়েছে পুলিশ! পঙ্কজের অভিযোগ, ‘‘সন্ত্রাস আগেও ছিল। কিন্তু এমন বল্গাহীন সন্ত্রাস ছিল না।’’ অভিযোগ, পুলিশের কিছু শীর্ষ কর্তার ‘আপসের মনোভাব’ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে নিচু তলায়। ‘উপর তলা’র একাংশের অঙ্গুলিহেলনে অস্ত্র, মাদক, বিস্ফোরক উদ্ধারের তদন্ত চলে যাচ্ছে হিমঘরে। তদন্তে বহু প্রভাবশালী নেতা-কর্মী, মাঝারি মাপের নেতার নাম উঠছে। কিন্তু আপস-মনোভাবের দরুন তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy