Advertisement
E-Paper

‘বন্ধুর সঙ্গে হাঁটছিলাম, হঠাৎ ঘিরে ধরল’! অভিযোগপত্রে কী জানিয়েছেন দুর্গাপুরের ‘ধর্ষিতা’, সন্দেহ সহপাঠীর গতিবিধিতেও

ধর্ষণে অভিযুক্ত তিন জনকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবিবার তাঁদের দুর্গাপুর মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। বিচারক তাঁদের ১০ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ২৩:০০
দুর্গাপুর ‘গণধর্ষণকাণ্ডে’র তদন্তে রবিবার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখলেন তদন্তকারীরা।

দুর্গাপুর ‘গণধর্ষণকাণ্ডে’র তদন্তে রবিবার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখলেন তদন্তকারীরা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

মেরেকেটে তিন-চার লাইনের বয়ান। তাতেই দুর্গাপুরকাণ্ডের ‘ধর্ষিতা’ ডাক্তারি ছাত্রী জানিয়েছেন, বন্ধুর সঙ্গে তিনি ক্যাম্পাসের বাইরে হাঁটছিলেন। সেই সময় হঠাৎই ঘিরে ধরেন কয়েক জন। তার পরেই ধর্ষণ! পুলিশ সূত্রে খবর, ‘নির্যাতিতা’র এই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে মামলা রুজু হয়েছে। গ্রেফতারও হয়েছেন তিন জন। এখনও ‘আটক’ তরুণীর সেই বন্ধু-সহপাঠী। তাঁর কিছু গতিবিধিতেও তদন্তকারীদের মনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে যে তিন-চার লাইনের লিখিত বয়ান জমা দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বর্ষের ওই ডাক্তারি ছাত্রী, সেটাই পরে পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ‘নির্যাতিতা’ ওই ছাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে জানা গিয়েছে, রাত ৮টা থেকে ৮টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে গোটা ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে তিন জন মিলে তরুণীকে ঘিরে ধরেন। সেই সময় তরুণী তাঁর কলেজের বন্ধুদের ফোন করে খবর দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁর ফোনটি কেড়ে নেওয়া হয়। পরে আরও দু’জন আসেন। সব মিলিয়ে পাঁচ জন মিলে তরুণীকে ধর্ষণ করেছেন। অভিযুক্তেরা তরুণীকে পরে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ফোন ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্যেও বলেছিলেন বলে অভিযোগ।

তদন্তকারীদের সূত্র জানিয়েছে, তরুণীকে পাঁচ জন ঘিরে ধরার পরেই সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সহপাঠী বন্ধুটি। রবিবার এই অভিযোগ করেছিলেন ‘নির্যাতিতা’র বাবা। তিনিও পুলিশের কাছে একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। তাতে গোটা ঘটনার সঙ্গে ওই সহপাঠীও জড়িত বলে দাবি করেছেন তিনি। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের বক্তব্য, বান্ধবী বিপদে পড়েছেন দেখেও তাঁকে ফেলে রেখে সহপাঠী-বন্ধুটি যে ভাবে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে নানা প্রশ্ন ওঠারই কথা। শুধু তা-ই নয়, পালিয়ে গিয়ে তিনি কলেজ থেকে অন্য বন্ধুদেরও ডেকে নিয়ে যেতে পারতেন। তা-ও কেন তিনি করলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে তদন্তকারীদের একাংশের মনে।

ধর্ষণে অভিযুক্ত তিন জনকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবিবার তাঁদের দুর্গাপুর মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। বিচারক তাঁদের ১০ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকিদের খোঁজেও তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলে খবর পুলিশ সূত্রে। মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, দুর্গাপুরের ঘটনায় অভিযুক্তদের কাউকেই রেয়াত করা হবে না।

পাশাপাশি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির উচিত পড়ুয়াদের, বিশেষত ছোট মেয়েদের রাতে বাইরে বেরোতে না-দেওয়া। তাদের নিজেদেরও সুরক্ষিত থাকতে হবে।” মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেন যে, “বিভিন্ন রাজ্যের যে সমস্ত ছেলেমেয়ে পড়তে আসেন, তাঁদেরও আমি অনুরোধ করব, রাত্রিবেলা না-বেরোতে। কারণ, পুলিশ তো জানতে পারে না, কে কখন বেরিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ তো বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকবে না।”

‘নির্যাতিতা’ ওড়িশার বাসিন্দা। ধর্ষণের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরেই শনিবার ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, যাতে দোষীর সাজা নিশ্চিত করা হয়। ‘নির্যাতিতা’ যাতে বিচার পান। রবিবার মমতা প্রশ্ন তোলেন, ওড়িশায় মেয়েদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করেছে সরকার। তিনি বলেন, “তিন সপ্তাহ আগে ওড়িশায় সমুদ্রসৈকতে তিনটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় ওড়িশা সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? বাংলায় কিছু হলে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিই।” মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশায় নারী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ওই জায়গাগুলোয় এগুলো ঘটলে ওরা (বিজেপি) গুরুত্ব দেয় না। সেখানে ধর্ষিতা আদালতে যাওয়ার আগেই রাস্তায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আমরা কোনও ঘটনাকেই সমর্থন করি না। আমরা এই সমস্ত ঘটনাকে রেয়াত করি না।”

রবিবার দুর্গাপুরে ওড়িশা সরকারের এক মহিলা সদস্য-সহ তিন প্রতিনিধি এসেছিলেন ‘নির্যাতিতা’র সঙ্গে দেখা করতে। সেই প্রতিনিধিদলে এক পুলিশ আধিকারিক এবং জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক ছিলেন। কিন্তু অভিযোগ, তাঁদের জন্য হাসপাতালের গেটই খোলা হয়নি। দীর্ঘ ক্ষণ তাঁরা বা‌ইরে অপেক্ষা করেছেন। হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু শেষমেশ তাঁদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বলেই অভিযোগ। এর পর তাঁরা হাসপাতাল থেকে চলে যান।

‘নির্যাতিতা’র বাবার বিবৃতি

দুর্গাপুরকাণ্ডের ‘নির্যাতিতা’ ডাক্তারি ছাত্রীকে বাংলা থেকে ওড়িশায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন তাঁর বাবা। এ ব্যাপারে তিনি ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহনচরণ মাঝীকে অনুরোধও করেছেন বলে জানিয়েছেন। ‘নির্যাতিতা’র বাবা বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছি, যাতে মেয়েকে এখান থেকে ওড়িশায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই জায়গার উপর থেকে ভরসা উঠে গিয়েছে। ওকে (মেয়েকে) মেরেও ফেলতে পারে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘রাত ১০টায় ওর বন্ধু (মেয়ের বন্ধু) ফোন করে জানায়, আমার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ওর একটা বন্ধু ওকে খেতে নিয়ে গিয়েছিল বাইরে। কিন্তু যখন দু’-তিন জন ওকে (মেয়েকে) ঘিরে ধরে, তখন ওর বন্ধুটি পালিয়ে যায় ওকে ছেড়ে। রাত ৮-৯টার মধ্যে ঘটনাটা ঘটেছে। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। কোনও পদক্ষেপ করা হচ্ছে না। কোনও ব্যবস্থাই নেই এখানে।’’

বিতণ্ডায় বিজেপি-অভয়ামঞ্চ

নির্যাতিতার বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রবিবার বিজেপির কর্মীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়েছেন অভয়া মঞ্চ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্‌স ফোরামের সদস্যেরা। আঙুল উঁচিয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। রবিবার দুর্গাপুরকাণ্ডে নির্যাতিতার বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁরা আরজি কর আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছিলেন নির্যাতিতার বাবার কাছে। তাঁরা নির্যাতিতার বাবাকে জানান, গত দেড় বছর ধরে আন্দোলন চলছে। সরকারের বিরুদ্ধেও তাঁরা আন্দোলন চালাচ্ছেন। নিজেদের আন্দোলনের কথা জানিয়ে, নির্যাতিতার বাবার ফোন নম্বর চান তাঁরা। এই কথাবার্তা চলার মাঝেই পাশ থেকে এক ব্যক্তি নির্যাতিতার বাবার কানে কানে কিছু বলে দেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওই ব্যক্তি এবং আরও কয়েক জন মিলে নির্যাতিতার বাবাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দাবি করা হচ্ছে, তাঁরা সকলেই বিজেপি কর্মী। নির্যাতিতার বাবাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এক জনকে বলতে শোনা যায়, “আপনারা কত ‘জাস্টিস’ দেবেন, আমরা জানি।” তাতেই পরিস্থিতি তপ্ত হয়ে ওঠে। অভয়া মঞ্চ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্‌স ফোরামের সদস্যেরা তাঁদের দিকে ছুটে যান। তাঁদের থামিয়ে জানতে চান, কেন ওই মন্তব্য করা হল। এর পরেই দু’পক্ষের মধ্যে বচসা বেধে যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে দু’পক্ষই একে অন্যের দিকে আঙুল উঁচিয়ে উঁচু স্বরে তর্কাতর্কি শুরু করে দেন। যদিও পরে নির্যাতিতার বাবাকে বিজেপি কর্মীরা সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।

নেশার ঠেকে ‘গণধর্ষণ’

কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব মেরেকেটে ৭০০ মিটার। পাশেই ঝোপজঙ্গল। সেখানেই বসত মদ-গাঁজার ঠেক। দুর্গাপুর ‘গণধর্ষণকাণ্ডে’ ধৃত তিন জন সেই ঠেকেই ছিলেন। রাস্তায় ডাক্তারি ছাত্রী এবং তাঁর সহপাঠীকে দেখে তাঁরা প্রথমে তরুণীকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেন। তার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এমনটাই খবর পুলিশ সূত্রে। তদন্তকারীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, জঙ্গলের যে জায়গায় দীর্ঘ দিন ধরেই মদ-গাঁজার ঠেক বসে, সেখানে একাধিক বার সেখানে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। অতীতে গ্রেফতারও হয়েছিলেন কয়েক জন। কিন্তু তা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। ‘নির্যাতিতা’ কলেজে ফিরে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরেই পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়। পুলিশ সূত্রে খবর, তদন্তে নেমেই ঘটনাস্থলের কাছে জঙ্গলের ওই নেশার ঠেকে তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে কয়েক জনকে আটকও করা হয়। তার পর তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিযুক্তদের নাগাল পান তদন্তকারীরা। পরে মেয়েটির যে ফোনটি তাঁদের কাছে ছিল, সেটির ‘লোকেশন ট্র্যাক’ করে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, নেশার ঠেক থেকে কয়েক জনকে আটক করার পর তাঁদের ‘নির্যাতিতা’র সহপাঠীর সামনে হাজির করানো হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে থেকেই তিন জনকে চিহ্নিত করেন ওই সহপাঠী।

Durgapur police investigation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy