চেয়ারে তাপস মল্লিক। সামনে ডাক্তার।
তাপস ডাক্তারবাবুর কানের কাছে গিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল।
সিআইডি অফিসার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু, এক ছাত্রকে খুনে অভিযুক্ত আপনার বন্ধু। এটা মাথায় রাখবেন।’’ তার পরই অধস্তন অফিসারদের নির্দেশ, ‘‘এখানে সঠিক ডাক্তারি পরীক্ষা হবে না।
একে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে চলো।’’
রবিবারের দুপুর। ডায়মন্ড হারবারের আইটিআই ছাত্র কৌশিক পুরকাইতকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগে ধৃত শাসক দলের নেতা তাপস মল্লিককে সিআইডি-র সদর দফতর ভবানী ভবনে নিয়ে আসার পথে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে। সেখানেই ধৃত নেতার প্রতি চিকিৎসকদের খাতির-যত্ন দেখে বেজায় বিরক্ত সিআইডি অফিসাররা। এক ঝটকায়
হাসপাতাল থেকে বের করে তাপসকে সোজা প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। রোগীদের আত্মীয়-স্বজন তখন বলছেন, নেতার দাপট বটে! খুনের পরেও আদর কমছে না!
কলকাতায় আসার পথে তাপসকে আমতলা হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান সিআইডি অফিসাররা। সেখান থেকে ফের তাকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। ওই অফিসার তখনও বিরক্তিতে বিড়বিড় করছিলেন, ‘‘সব কিনে রেখেছে। তোলাবাজির অনেক টাকা! এ বার দেখাচ্ছি।’’
সিআইডি হেফাজতে তাপসকে যাতে কোনও কষ্ট দেওয়া না হয়, সে জন্য ডায়মন্ড হারবারের স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব ফোনে অনুরোধ জানাচ্ছেন বলে দাবি তদন্তকারীদের। কয়েক জন অফিসার বিষয়টি বড়কর্তাদেরও জানিয়েছেন। এক অফিসারের কথায়, ‘‘কোনও ভাবেই রেয়াত করা হবে না। তদন্ত নিজের গতিতেই চলবে। কোনও চাপ ও অনুরোধে কাজ হবে না।’’ স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব অনুরোধ জানানোর কথা মানেনি।
সোমবার রাতে মোষ চুরির অপবাদে কৌশিককে পিটিয়ে মারা হয়। সেই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার দত্তপুকুর থানার বামনগাছি এলাকা থেকে তাপস ও তার সঙ্গী বিল্লুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধরা হয় আরও চার জনকে। পরে তদন্তভার নেয় সিআইডি। ছ’জনকেই রবিবার ভবানীভবনে আনা হয়েছে। তার আগে শনিবার কৌশিকের বাবা-মায়ের কাছ থেকে গোটা ঘটনা লিখিত আকারে নিয়েছেন সিআইডির তদন্তকারীরা। ভিডিও রেকর্ডিংও করা হয়। কৌশিকের দাদা সুমনের অভিযোগ, তাপসের দলবল তাঁদের হুমকি দিচ্ছে।
প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সিআইডির দাবি, তাপস ও বিল্লু ছাড়া সে দিন ডায়মন্ড হারবারের পশ্চিমপাড়ার তৃণমূল কর্মী যুবরাজ মাঝি ও দেবরাজ মাঝিও কৌশিককে মারধর করে। কৌশিককে আটক করার পরই তাপসকে ফোন করা হয়। তাপস ঘটনাস্থলে আসার পরই মারধর শুরু হয়। কৌশিকের মা ও মাসি ঘটনাস্থলে পৌঁছলে দেবরাজ ও যুবরাজের স্ত্রীরা কৌশিককে ছেড়ে তাঁদের উপরে চড়াও হয় বলে অভিযোগ। কৌশিককে যখন মারধর চলছে, তখন তাপস মোষ চুরির ক্ষতিপূরণ নিয়ে তার মা-মাসির সঙ্গে দরাদরি করছিল। ক্ষতিপূরণে রাজি না হলে মারধর বন্ধ হবে না বলেও হুমকি দেয় তাপস। তাঁদের থেকে মুচলেকা নেওয়ার পর কৌশিকের উপর মারধর বন্ধ হয়। মায়ের কোলে আধ ঘণ্টা মুখ গুঁজে থেকে ধীরে ধীরে নিথর হয়ে যায় কৌশিকের দেহ। তার পরেই যুবরাজ ও দেবরাজ সপরিবার পালায়। পরের দিন দুপুরে পালায় তাপস।
মারধরের ঘটনায় সে কোনও ভাবেই জড়িত নয় বলে তদন্তকারীদের জেরায় দাবি করেছে তাপস। এক তদন্তকারী জানান, তাপস দাবি করেছে, মারধরের খবর পেয়ে সে পশ্চিমপাড়ায় যায়। ছেলেটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু নিজের বাড়ির পাশে কারা ওই দিন কৌশিককে মারধর করে, তা কবুল করেনি। তাপসের সাকরেদ বিল্লু জেরায় জানিয়েছে, ওই দিন সে তারাপীঠে ছিল। বিল্লুর মোবাইলের কল-লিস্ট পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং সে তারপীঠের কোথায় ছিল, তা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
এ দিন কৌশিকের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁদের আইনি সহায়তার আশ্বাস দেন। জয়ন্তনারায়ণবাবু বলেন, ‘‘সঠিক তদন্তের দাবিতে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হবে। এই পরিবারটির পাশে আমরা সবাই রয়েছি।’’