Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
মজায় আছেন মনিরুল

অস্ত্র আইনেও মামলার অনুমতি আসেনি ৭ দিনে

হাইকোর্টের চাপে নড়ে বসেছিল পুলিশ। খুনের অভিযোগ না-আনলেও তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে চার্জশিট দেওয়ার জন্য জেলাশাসকের অনুমতি চেয়েছিল। সাত দিন কেটে গিয়েছে। জেলাশাসক এখনও কিছু জানাননি। ফলে লাভপুর মামলায় মনিরুলের বিরুদ্ধে আদৌ আইনি পদক্ষেপ করা হবে কি না, তা নিয়ে রীতিমতো ধন্দ দেখা দিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৪ ০৩:৩০
Share: Save:

হাইকোর্টের চাপে নড়ে বসেছিল পুলিশ। খুনের অভিযোগ না-আনলেও তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে চার্জশিট দেওয়ার জন্য জেলাশাসকের অনুমতি চেয়েছিল। সাত দিন কেটে গিয়েছে। জেলাশাসক এখনও কিছু জানাননি। ফলে লাভপুর মামলায় মনিরুলের বিরুদ্ধে আদৌ আইনি পদক্ষেপ করা হবে কি না, তা নিয়ে রীতিমতো ধন্দ দেখা দিয়েছে।

পুলিশ কর্তারা অবশ্য বলছেন, জেলাশাসকের অনুমোদন পেলেই অস্ত্র আইনে অতিরিক্ত চার্জশিট আনা হবে। সেই অনুমোদন কবে মিলবে? তা জানে না পুলিশ! লাভপুর-মামলায় নিহতদের পরিবারের আশঙ্কা, নানা আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে মামলাটিকে পিছিয়ে দিতে চাইছে প্রশাসন। আর কখনও নিজেদের ভিটেয় ফিরতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নটাই এখন তাড়া করছে তাঁদের।

জেলাশাসক কী বলছেন? জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, “আমার কাছে পুলিশ সুপারের সুপারিশ এসেছে। আমি সরকারি আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।” যদিও বোলপুর আদালতের সরকারি আইনজীবী ফিরোজ পাল দাবি করছেন, জেলাশাসক এখনও তাঁর সঙ্গে কোনও কথা বলেননি। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সাত দিনের মধ্যেও মামলাটি নিয়ে কোনও অগ্রগতি হল না কেন, সে প্রশ্ন অতএব উঠছেই।

নিহতদের পরিবারের অভিযোগ, এর আগেও এক বার পুলিশ মনিরুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে চার্জ আনতে চেয়ে জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেছিল। তৎকালীন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তখন মনিরুলকে অভিযুক্ত করেনি পুলিশ। ফলে এক বার অস্ত্র আইনে চার্জ আনার অনুমোদন দেওয়ার পরে ফের নতুন করে সেই অনুমতি দেওয়া যায় কি না, এখন সেই প্রশ্নও উঠেছে।

কিন্তু মনিরুলের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ থাকলেও পুলিশ শুধু অস্ত্র আইনে মামলা করতে চাইছে কেন?

জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, ২০১০ সালের ৪ জুন সিপিএম সমর্থক একটি পরিবারের তিন ভাই জাকের আলি, কোটন শেখ এবং ওইসুদ্দিন শেখের খুনের ঘটনায় মাস দুয়েক ফেরার থাকার পরে পুলিশ মনিরুলকে গ্রেফতার করেছিল। পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন মনিরুলের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে দু’টি বন্দুকও পাওয়া যায়। কিন্তু সে সময় পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি। উপরন্তু ঠিক সময়ে চার্জশিট দিতে না-পারায় মনিরুল জামিন পেয়ে যান। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল তাঁকে লাভপুর কেন্দ্রে দাঁড় করায়। তিনি জিতেও যান। এর পরে মনিরুলের দাপট আরও বাড়ে। খুনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে নিহতের পরিবারের উপরে চাপও বাড়ে। সেই চাপের মুখে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বয়ান দিতে গিয়ে নিহতদের পরিবারের লোকেরা বলেন, ঘটনার সময়ে মনিরুল উপস্থিত ছিলেন না।

নিহতদের পরিজনদের অভিযোগ, গোপন জবানবন্দিতে যাতে মনিরুলের নাম না-করা হয়, সে জন্য নিহত কোটন শেখের ছেলে নেবলু (তখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র) এবং নিহতদের এক ভাই সানোয়ার শেখের মেয়ে টুম্পা খাতুনকে (তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী) বিধায়কের লোকজন অপহরণ করেছিল। নিহতদের এক ভাই আনারুল শেখ এ দিনও বলেন, “মনিরুল ঘটনায় জড়িত নয়, এই মর্মে আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য সেই সময় আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন লাভপুর থানার এক অফিসারও। ভাইপো-ভাইঝিকে অপহরণের অভিযোগটাও জানানোর সুযোগ পাইনি। বাড়ির বাকি লোকেদের প্রাণ বাঁচাতেই তখন মনিরুল নির্দোষ বলে জবানবন্দি দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।”

ওই জবানবন্দির ভিত্তিতেই তৃণমূল বিধায়কের উপর থেকে খুনের মামলা উঠে যায়। গোটা মামলাটিই ধামাচাপা পড়ে যায়। এমনকী মামলার চার্জশিট দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি পুলিশ। কিন্তু গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এক সভায় মনিরুল নিজেই বলেন, “আমি লাভপুরের বিধায়ক, পায়ের তল দিয়ে, মাইয়াটার উপর দিয়ে যারা অত্যাচার করেছিল, তাদের তিন জনকে পায়ের তল দিয়ে মেরে দিয়েছি!” কোন মেয়ের উপরে নির্যাতনের কথা বলছেন, তা অবশ্য তিনি কখনওই খোলসা করেননি।

এ বছর মার্চ মাসে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন নিহতদের আর এক ভাই সানোয়ার শেখ। গত ৩১ মার্চ মামলার শুনানিতে ঘটনার চার বছর পরেও চার্জশিট দিতে না-পারায় পুলিশকে ভর্ৎসনা করে আদালত। কেন তদন্তে এত বিলম্ব, কেনই বা চার্জশিট দেওয়া গেল না, পুলিশকে তা জানানোর নির্দেশ দেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। পরের শুনানিতে তাদের রিপোর্ট দেখে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। গোপন জবানবন্দিতে সানোয়াররা কেন মনিরুলের নাম নেননি, তা নিয়ে লাভপুর থানার আইসি-র রিপোর্টও তলব করেন বিচারপতি।

হাইকোর্টের চাপেই অবশেষে গত সপ্তাহে বোলপুর আদালতে লাভপুর-খুনের মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু এ বারেও মনিরুল-সহ ২২ জনের নাম সেই চার্জশিটে নেই। জেলা পুলিশের বক্তব্য, আত্মীয়দের বয়ানে মনিরুলদের নাম না-থাকাতেই খুনের চার্জ দেওয়া যায়নি। পরে পুলিশ মনিরুলকে অস্ত্র আইনে অভিযুক্ত করে অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দেওয়ার অনুমতি চেয়ে জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেছে। সেই আবেদনও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মঞ্জুর হয়নি।

চার বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল লাভপুরে?

দীর্ঘদিন ধরে ময়ূরাক্ষী নদীর কয়েকটি বেআইনি বালি-ঘাটের দখল নিয়ে সিপিএম বনাম ফরওয়ার্ড ব্লক সমর্থকদের দু’টি গোষ্ঠীর বিবাদ ছিল। তারই সিপিএম গোষ্ঠীতে ছিল নিহতদের পরিবার। ফব গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন মনিরুল। তখন তিনি লাভপুরের দাঁড়কা পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পরে মনিরুলের হাত ধরেই ওই গোষ্ঠীটি তৃণমূলে যোগ দেয়। কিন্তু দু’পক্ষের বিবাদ থামেনি।

সমস্যা মেটাতে ২০১০ সালের ৪ জুন সন্ধ্যায় নবগ্রামে মনিরুলের বাড়িতে বৈঠকে ডাকা হয় নিহতদের পরিবারকে। সেখানে আসেন পাঁচ ভাই জাকের আলি, কোটন শেখ, ওইসুদ্দিন শেখ, সাইফুদ্দিন শেখ, জামাল শেখ, সানোয়ার শেখ এবং সানোয়ারের দুই ছেলে-সহ মোট ৮ জন। সেই সময় মনিরুল বীরভূম জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি। সভায় বচসা চরমে ওঠে। তখনই মনিরুলের নেতৃত্বে জাকের, কোটন এবং ওইসুদ্দিনকে পিটিয়ে ও বোমা মেরে বাড়ির উঠোনেই খুন করা হয় বলে অভিযোগ। প্রচণ্ড মারে গুরুতর আহত হন জামাল শেখ। জাকের, কোটন এবং ওইসুদ্দিনের মৃতদেহের সঙ্গে জামালকেও মৃত ভেবে মাঠে ফেলে দেয় আততায়ীরা। সাইফুদ্দিন, সানোয়ার ও তাঁর দুই ছেলে মারাত্মক জখম অবস্থায় কোনও মতে পাঁচিল টপকে প্রাণ বাঁচান।

সে দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে জামাল এ দিন বলছিলেন, “রান্নাঘরের চালে গুঁজে রাখা শাবল নিয়ে প্রথমে চড়াও হন মনিরুল নিজেই। তাঁর দেখাদেখি বাকিরাও লাঠি, টাঙ্গি, বল্লম, তরোয়াল নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শাবলের বাড়ি মেরে আমার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়। লুটিয়ে পড়ি আমি। আমার উপরে আছড়ে পড়ে দাদা কোটন। সাড় নেই। দাদার রক্তের সঙ্গে আমার রক্ত চোখে-মুখে লেপটে যাচ্ছে।” জামালের কথায়, “টুঁ শব্দ করলেই ওরা পাছে ফের ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই ভয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মড়ার মতো পড়েছিলাম। মরে গিয়েছি ভেবে আরও কয়েকটা দেহের সঙ্গে আমাকেও ওরা বাড়ি থেকে তুলে কিছু দূরে ফেলে দেয়।”

এ সব কোনও কথাই অবশ্য তৃণমূল বিধায়ক এখন স্বীকার করছেন না! বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “আমি কোনও ঘটনাতেই জড়িত নই। আনন্দবাজার মিথ্যা লিখছে। সব কিছু সাজাচ্ছে।” পুলিশ যে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করেছে, সেটাও কি সাজানো? মনিরুলের জবাব, “পুলিশ-প্রশাসন নিজের মতো ব্যবস্থা নিচ্ছে।” পুলিশের অভিযোগ কি সত্যি? উত্তর আসে, “এ ভাবে বারবার আমাকে বিরক্ত করবেন না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chargesheet Manirul Arms Act parui case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE