E-Paper

ঋণের ফাঁসে হঠাৎ বন্দি নব্য প্রতারণায়

কলকাতা, ব্যারাকপুর এবং বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট মিলিয়ে গত তিন মাসে এমন প্রায় ৩৫০টি অভিযোগ জমা পড়েছে বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ঋণ নেওয়া হয়েছে অ্যাপ-নির্ভর ঋণদানকারী সংস্থা থেকে।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫ ০৭:৫১

— প্রতীকী চিত্র।

তাঁর নামে রয়েছে ৬০ লক্ষ টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ! কিন্তু, তিনি নিজেই তা জানেন না। নারকেলডাঙার একটি আবাসনের ওই নিরাপত্তারক্ষী চিত্তরঞ্জন সাধুখাঁর বাড়িতে মাঝেমধ্যেই বকেয়া ঋণ আদায়কারী দলের লোক আসছেন। লোকজন জড়ো করে চলছে সামাজিক সম্মান লুণ্ঠিত করার চেষ্টা। যদিও বছর পঞ্চাশের ওই ব্যক্তির দাবি, ঋণ মিটিয়ে দেওয়া তো দূর, আইনি লড়াই লড়ারও সামর্থ্য নেই তাঁর। চিত্তরঞ্জনের মেয়ে রেখা বললেন, ‘‘এই ঋণ তো বাবা নেয়ইনি। ব্যাঙ্কের লোক এসে বলছে, মাসে মাসে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে নাকি ঋণ মেটাতে হবে! বাবা তো মাসে বেতনই পান মাত্র ১৫ হাজার টাকা!’’

কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতা, ব্যারাকপুর এবং বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট মিলিয়ে গত তিন মাসে এমন প্রায় ৩৫০টি অভিযোগ জমা পড়েছে বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ঋণ নেওয়া হয়েছে অ্যাপ-নির্ভর ঋণদানকারী সংস্থা থেকে। সেখানে মূলত আধার বা ভোটার ও প্যান কার্ডের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া হয়েছে। কয়েক মিনিটেই ঋণ পাইয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপনী প্রচার কার্যকর করতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা হয়নি, নথি যাঁর নামে জমা পড়েছে, ঋণের আবেদনকারী তিনিই কি না! এই পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীদের দাবি, অ্যাপ-নির্ভর ওই সমস্ত সংস্থায় যোগাযোগ করলেও সুরাহা মিলছে না। হয় কেউ ফোন ধরে কথা বলছেন না, নয়তো এমন সংস্থার নথিভুক্ত অফিস রাজ্যের বাইরে বলে জানা যাচ্ছে। ঋণের টাকা কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া হয়ে থাকলে সেই ব্যাঙ্কও দায় নিতে চাইছে না বলে অভিযোগ। ভুক্তভোগীকে বহু ক্ষেত্রেই বলে দেওয়া হচ্ছে, ‘আপনার নামেই নথি দিয়ে ঋণের আবেদন করা হয়েছে। ফলে দায় আপনারই।’ অভিযোগ, থানায় লিখিত অভিযোগ পেলেও আদৌ পদক্ষেপ করা হচ্ছে কি না, জানা যাচ্ছে না। বার বার থানায় ঘুরে শুনতে হচ্ছে, ‘আপনার নিজের নামেই যখন নথি, তখন আপনিই যে টাকাটা নেননি, আগে তো সেটা প্রমাণ করতে হবে!’

বেহালার বাসিন্দা এক ভুক্তভোগীর আবার দাবি, তিনি একটি অনলাইন সংস্থার অ্যাপ ডাউনলোড করে দিনকয়েক আগে তাতে ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজখবর করেছিলেন। এর পরে হঠাৎ এক দিন জানতে পারেন, তাঁর নামে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। দেখা যায়, অ্যাপ নামানোর সময়ে তিনি নিজের ছবি, ভিডিয়ো-সহ বেশ কিছু ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন। ফোনে থাকা আধার এবং প্যান কার্ডের তথ্য হাতিয়ে নিয়ে শুধু ভুয়ো ঋণের কারবার করা হয়েছে তা-ই নয়, এখন টাকা না মেটালে ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ফোন নম্বরের তালিকায় থাকা লোকজনকে ফোন করে বলা হচ্ছে, ‘আপনাকেই গ্যারান্টার রেখে ঋণ নেওয়া হয়েছে। ফলে, তিনি শোধ করতে না পারলে আপনাকেই টাকা দিতে হবে।’ সিঁথি এলাকার বাসিন্দা এক প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা জানালেন, একই ভাবে তাঁর নামেও ঋণ নেওয়া হয়েছে প্রায় ২২ লক্ষ টাকার। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে এই কাণ্ড হওয়ার পরে তিনি সেখানে যোগাযোগ করলে তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁর নামেই সমস্ত নথি জমা পড়েছে।

সাইবার বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, হোটেলেই হোক বা কোনও দোকানে, ব্যক্তিগত নথির প্রতিলিপি কোথাও জমা দিলে তা যে সুরক্ষিত থাকবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। সেই নথি ব্যবহার করেই পরে এই ধরনের ঋণের আবেদন করা হতে পারে। ফলে ঋণদানকারী সংস্থা সব সময়ে ধরতে পারে না।

‘অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি তথা ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যাঙ্ক কর্মচারী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক রাজেন নাগর এ বিষয়ে বললেন, ‘‘কেউ যদি সমস্ত নথিপত্র নিয়েই ঋণের আবেদন করেন, তা হলে ব্যাঙ্কের পক্ষেও ধরা কঠিন। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকেই সতর্ক হতে হবে। এমন ভুয়ো ঋণ তৈরি হয়ে গেলে আইনি লড়াই করাই একমাত্র পথ।’’ ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং‌’-এর অধিকর্তা তথা সাইবার গবেষক সন্দীপ সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘কারও অজানতে এমন ঋণ নেওয়া হয়ে থাকলে দ্রুত এফআইআর করাতে হবে। এর পরে দ্রুত পদক্ষেপ করাতে প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ব্যাঙ্ক ও পুলিশকে দিক্-নির্দেশ দেওয়ার মতো অর্ডার বার করাতে হবে।’’

কিন্তু যাঁদের এই মামলা লড়ার সঙ্গতি নেই, তাঁদের কী হবে?

উত্তর মেলে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Financial Fraud police investigation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy