Advertisement
E-Paper

‘এনআরসি-আতঙ্কে আত্মহত্যা’: কাটা আঙুল, থ্রি-পাশ, সুইসাইড নোট নিয়ে প্রশ্ন বিজেপির! মৃতের বাড়িতে অভিষেক, তরজা তুঙ্গে

মঙ্গলবার আগরপাড়ার ফ্ল্যাট থেকে প্রদীপ করের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘরেই মেলে একটি ডায়েরি। দাবি, তাতে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য এনআরসি দায়ী।’ কিন্তু যাকে ‘সুইসাইড নোট’ বলা হচ্ছে, সেটি আদৌ প্রদীপ লিখেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তদন্ত দাবি করেছে বিজেপি।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৫ ২০:১০
Agarpara Death Case

আগরপাড়ায় প্রদীপ করের (পিছনে) মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক। একে অপরের দলকে দুষলেন শুভেন্দু অধিকারী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।

‘এনআরসি-র ভয়ে আত্মঘাতী’ হয়েছেন প্রদীপ কর। তেমনই বলেছে তাঁর সুইসাইড নোট। কিন্তু সেই লিখিত বয়ান নিয়েই তরজা বেধেছে তৃণমূল-বিজেপির।

প্রদীপের মৃত্যুর বিচার চেয়ে বৃহস্পতিবার পানিহাটিতে তৃণমূল মিছিল করবে বলে ঘোষণা করেছেন শাসকদলের অন্যতম শীর্ষনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নেতৃত্বে থাকবেন ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিক। সারা রাজ্য জুড়ে রাস্তায় নামবে তৃণমূল। বুধবার প্রদীপের পরিজনদের সঙ্গে দেখা করে অভিষেক স্লোগান তোলেন, ‘বাংলার একটাই স্বর, জাস্টিস ফর প্রদীপ কর।’

অভিষেকের ঘোষণার পর পানিহাটিতেই আগামী মঙ্গলবার (এইদিনই রাজ্যে এসআইআরের কাজ শুরু হবে) মিছিল করার কথা ঘোষণা করেছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। ‘তৃণমূলের মিথ্যাচারের’ বিরুদ্ধে এই মিছিল করা হবে বলে জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা।

কিন্তু তার আগে প্রদীপের মৃত্যু এবং তাঁর দেহের পাশ থেকে উদ্ধার করা সুইসাইড নোট নিয়ে তুমুল বচসা শুরু হয়েছে যুযুধান দুই শিবিরের। বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে, প্রদীপ কি আদৌ লিখতে সক্ষম ছিলেন? এর কারণ মৃত প্রদীপের পরিবারের কয়েকজন সদস্যের মন্তব্য। যে মন্তব্য বলছে, প্রদীপ তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর ডান হাতের চারটি আঙুল পুরো নেই। প্রদীপ বাঁহাতে লিখতেন, এমন কোনও তথ্যও মেলেনি। সেই সূত্রেই প্রদীপের দেহের পাশ থেকে উদ্ধার-করা সুইসাইড নোটের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল। বুধবার তাদের স্থানীয় নেতৃত্ব ওই মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি করেছেন। বিজেপির নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘‘তদন্ত হওয়া উচিত। সুইসাইড নোটটি কে লিখেছেন তা জানা প্রয়োজন।’’ সুকান্ত ওই আত্মহত্যার দায় তৃণমূলের উপরেই চাপিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘এনআরসি তো চালুই হয়নি! এনআরসি নিয়ে মানুষকে ভয় দেখিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। দায় তাঁদের।’’

পক্ষান্তরে, বুধবার দুপুরে প্রদীপের শোকগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে অভিষেক আরও এক বার বলেছেন, এনআরসি-এসআইআরের আতঙ্কেই আত্মঘাতী হয়েছেন ৫৭ বছরের ওই প্রৌঢ়। তাঁর অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হওয়া উচিত। সুইসাইড নোট নিয়ে বিজেপির তোলা প্রশ্ন প্রসঙ্গে তাঁর শ্লেষপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘একটা রাজনৈতিক দল এত নীচে নামতে পারে! ওঁকে (প্রদীপ) ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে? তিনি লিখতে পারেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে? তিনি লিখে দিয়ে গিয়েছেন… তার পরেও রাজনীতি হবে?’’

পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার ওই বাসিন্দার অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। মঙ্গলবার সকালে আগরপাড়ার ফ্ল্যাটে তাঁর ঘর থেকে প্রদীপের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ওই ঘরেই মেলে একটি ডায়েরি। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মুরলীধর ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গিয়েছে। বাড়ির লোকজন এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, প্রদীপ এনআরসি সংক্রান্ত নানা খবর নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সুইসাইড নোটে এনআরসি-র কথার উল্লেখও আছে।’’ ঘটনাচক্রে, তার আগেই সমাজমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, ‘‘৫৭ বছর বয়সি প্রদীপ কর আত্মহত্যা করেছেন। একটি চিরকুট রেখে গিয়েছেন তিনি। যেখানে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্য এনআরসি দায়ী।’ বিজেপির ভয় ও বিভাজনের রাজনীতির এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে?’’

মৃত প্রদীপ করের ছবিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

মৃত প্রদীপ করের ছবিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছবি: ফেসবুক।

প্রদীপের দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনও মেলেনি। বুধবার তাঁর ভগ্নিপতি উত্তম হাজরা দাবি করেন, বেশিদূর লেখাপড়া করেননি প্রদীপ। তিনি আদৌ লিখতে জানতেন কি না, তা নিয়ে তাঁর সংশয় রয়েছে। উত্তমের কন্যা অর্থাৎ প্রদীপের ভাগ্নি জানান, একটি দুর্ঘটনায় তাঁর মামার ডান হাতের চারটি আঙুল অর্ধেক কাটা পড়েছিল। ওই সমস্ত মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই বিজেপি দাবি করে, সুইসাইড নোটটি নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

অবিবাহিত প্রদীপ ভাই এবং ভ্রাতৃবধূর সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকতেন। সোমবার রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি নিজের ঘরে শুতে যান। মঙ্গলবার সকালে ভ্রাতৃবধূ বার বার ডেকেও সাড়া না পেয়ে প্রদীপের ভাইকে ডাকেন। প্রতিবেশীরা আসেন। সমবেত ডাকাডাকিতেও সাড়া না মেলায় থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ গিয়ে প্রদীপের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে। পুলিশই উদ্ধার করে ‘বিতর্কিত’ সুইসাইড নোটটি। বুধবার সকালে মৃতের ভগ্নিপতি উত্তম বলেন, ‘‘উনি লিখতে জানতেন বলে তো জানি না। ক্লাস থ্রি-ফোর পর্যন্ত পড়েছেন। মশারির দোকান ছিল ওঁর। দোকান যখন চালাতেন, হয়তো কোনও ভাবে লিখতেন। কিন্তু আমরা কেউ কখনও ওঁকে লিখতে দেখিনি। হাতের লেখা ওঁর কি না বলতে পারব না।’’ পাশাপাশিই উত্তম বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরেই উনি পানিহাটি বিধানসভার ভোটার। উনি এ দেশেরই বাসিন্দা। তবে ওঁর বাবা বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন।’’

এর মধ্যেই বুধবার দুপুরে প্রদীপের বাড়িতে গিয়ে অভিষেক বেশ কিছু ক্ষণ মৃতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন। প্রদীপের ছবিতে মালা দিয়ে বেরিয়ে অভিষেক জানান, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য ছিলেন প্রদীপ। তাঁর অবর্তমানে পুরো পরিবার চিন্তায়। পাশাপাশিই অভিষেক দাবি করেন, এসআইআর ঘোষণার পরে রাজ্যের নানা এলাকায় এমন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ভয়ে ‘চরম পদক্ষেপ’ করে ফেলছেন মানুষ। কোচবিহারের দিনহাটার ঘটনারও উল্লেখ করেন তিনি। তার পরেই অভিষেক বলেন, ‘‘এসআইআর ঘোষণা হওয়ার পরে উনি (প্রদীপ) ঘরে ঢুকেছিলেন। সকালে দেখা গেল, উনি বেঁচে নেই! এটা কি কাকতালীয়?’’ তৃণমূল নেতার দাবি, ‘‘আট রাজ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রবেশ করে ভারতে। কিন্তু কেবল বাংলায় এসআইআর করার কারণ, দিল্লির কাছে আমরা মাথা নত করিনি!’’

এর অব্যবহিত পরে আবার আসরে নামে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রদীপের পরিবারের লোকই বলছেন, তাঁর চারটে আঙুল নেই, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি কী ভাবে এত সুন্দর করে লিখে ফেললেন! তাঁর পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি। তৃণমূল নাটক করুক। কিন্তু একটা ভাল নাটক লিখুক। এত দুর্বল চিত্রনাট্য কেন?’’ শমীক ব্যাখ্যা দেন, ‘‘আমরা বলিনি (সুইসাইড নোট নিয়ে), বলছেন তো পাড়ার লোকেরা। তিনি (প্রদীপ) এতটাই সচেতন যে তিনি এন‌আরসি জানেন, আবার তিনি নাকি ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি কী ভাবে মারা গিয়েছেন, এটা তদন্তসাপেক্ষ। তবে গোটা রাজ্যটাকেই সিবিআই অফিসে বসিয়ে দিলে ভাল হয়।’’

Abhishek Banerjee Panihati Agarpara TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy