রোজই পেটে ব্যথা হচ্ছিল ছেলেটির। দিন কয়েক এমন চলার পরে আচমকা শুরু হল শ্বাসকষ্ট। আর তা এমনই যে তড়িঘড়ি একটি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করতে হল তাকে। পেট ব্যথার কারণ খুঁজতে আলট্রাসোনোগ্রাফি হল। কিন্তু তাতেও মিলল না কিছুই। রোগ নির্ণয় ছাড়াই উপসর্গভিত্তিক কিছু ওষুধ আর অক্সিজেনে দিন কয়েক পরে সেরে উঠল ছেলেটি। কিন্তু মাস কয়েক পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তারদের মতামতের পরে এলেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন, ঘন ঘন বাইরের রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাস আছে কি? জানা গেল, খুব বেশি মাত্রাতেই আছে। আর তাতেই ধরা পড়ল আসল সমস্যাটা ঠিক কোথায়।
বর্ণ, গন্ধ আর স্থায়িত্ব। মুখরোচক খাবারের এই তিন বৈশিষ্ট্যেই কাত হয়ে পড়ছেন অনেকেই। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে মধ্যবয়স্ক পর্যন্ত রোগের প্রকোপটা বেশি।
এঁদের বেশির ভাগেরই পেট ব্যথা হচ্ছে, চোখ-মুখ ফুলে যাচ্ছে, গায়ে লাল চাকা-চাকা দাগ হচ্ছে। এরই সঙ্গে কারও কারও শুরু হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। এই রোগটির পোশাকি নাম আর্টিকেরিয়া।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই সমস্যার মূল উৎস খাবারে ব্যবহার করা রং, প্রিজারভেটিভ এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর রাসায়নিক। চর্মরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় ঘোষ জানিয়েছেন, তাঁদের চেম্বারে এখন এই ধরনের রোগীর ভিড় বাড়ছে। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা দেখছেন চিনা রেস্তোরাঁর খাবার আর সস থেকে এই সমস্যা হচ্ছে। এমনিতেই অনেকেরই চাইনিজ খাবারে নানা ধরনের অসুস্থতা হয়। হয়তো রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পরের দিনই শারীরিক অস্বস্তি শুরু হল। তা থাকল পরের বেশ কয়েকটা দিন ধরে। বিদেশে একে বলা হয় ‘চাইনিজ রেস্টোর্যান্ট সিনড্রোম’। চিকিৎসকেরা এই ধরনের সমস্যাকে ‘ফুড ইনটলারেন্স’ বলেও চিহ্নিত করেন। তবে শুধু চিনা খাবার নয়, যে কোনও ধরনের ফাস্ট ফুড, বিরিয়ানি, রঙিন মিষ্টিতে এই রাসায়নিক মিশে থাকার ভয় থাকে।
সঞ্জয়বাবু আরও বলেন, ‘‘রেস্তোরাঁর বেশির ভাগ খাবারেই রঙের জন্য অ্যাজোডাই নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া খাবার বেশি দিন ঠিক রাখার জন্য প্যারাবেন নামে একটি প্রিজারভেটিভও অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয়। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গন্ধও ব্যবহার করা হয়, যাতে ব্যবহৃত রাসায়নিক নানা শারীরিক বিপত্তি ডেকে আনে।’’
অনেকেরই এই সমস্যা ‘ক্রনিক’ হয়ে দাঁড়ায়। মাঝেমধ্যে মাথা চাড়া দেয়। ফের থিতিয়ে যায়। ডাক্তারেরা অনেক সময়েই প্রথমে রোগটার চরিত্র বুঝে উঠতে পারেন না। বহু কথাবার্তা বলে তবে জানা যায়। অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধ তো দেওয়া হয়ই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দিতে হয় স্টেরয়েডও। যদিও এর আসল চিকিৎসাটা কাউন্সেলিং বলেই মনে করছেন তাঁরা। সঞ্জয়বাবু বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই রোগীরা আমাদের পাল্টা জানতে চান, সবেতেই যদি এত সমস্যা, তা হলে খাব কী? কথাটা ভুল নয়। সত্যিই ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার জোগাড়। খাবারে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মান বা কোন জিনিস কতটা পরিমাণে ব্যবহার করা যায়, তার নজরদারির জোরালো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সেই কারণেই নিজেদের সতর্ক থাকতে হবে।’’
চর্মরোগ চিকিৎসক সন্দীপন ধরও জানান, বেশ কয়েক বছর আগে আর্টিকেরিয়া নিয়ে গবেষণা করে বিষয়টিকে সামনে এনেছিলেন ম্যালকম গ্রিভস। তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন, খাবারে অ্যালার্জি হয় বড় জোর পাঁচ শতাংশ ক্ষেত্রে। আর খাবারের প্রিজারভেটিভ থেকে অ্যালার্জি হয় অন্তত ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। তাঁর কথায়, ‘‘ধরা যাক, চিংড়ি মাছ। কারও হয়তো বাড়িতে চিংড়ি খেলে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু রেস্তোরাঁয় খেলে ভয়ানক শারীরিক অস্বস্তি হয়। তিনি বিভ্রান্ত। চিংড়িতে অ্যালার্জি আছে কি নেই, সেটাই তিনি বুঝতে পারছেন না। আসলে ওঁর সমস্যা তো চিংড়িতে নয়, সমস্যাটা প্রিজারভেটিভে।
আর সেই প্রিজারভেটিভ বাড়িতে নয়, রেস্তোরাঁর খাবারে ব্যবহার করা হয়।’’
প্যারাবেন নামে এক রাসায়নিককেই এ জন্য দায়ী করেছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, প্যারাবেন নিয়ে এখন সর্বত্রই বিস্তর চর্চা হচ্ছে। এমন কী বেশ কিছু প্রসাধনীর ক্ষেত্রেও ‘প্যারাবেন ফ্রি’ কথাটা উল্লেখ করা থাকছে। খাবারের ক্ষেত্রেও এটা খুবই জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা।
তা হলে সমাধানটা কী? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই রোগের মূল চিকিৎসাই হল কাউন্সেলিং। মনে রাখতে হবে, এই সমস্যা সকলের হয় না। কিন্তু যাঁদের হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনও ওষুধই দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের রাস্তা বাতলাতে পারবে না। রেস্তোরাঁর খাবারে আর্টিকেরিয়া হলে বাইরে খাওয়ার অভ্যাসটাই ছাড়তে হবে। তা না হলে পেট ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট কোনও এক দিন বড়সড় বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy