Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

শরীরকে হারিয়েই জিত দেবজ্যোতির

জন্মের পর থেকেই ঠিক করে পা ফেলতে পারে না ছেলেটি। দু’ পায়ের বুড়ো আঙুলের উপরে ভর দিয়ে কোনও রকমে দাঁড়ায়। ঠিক মতো কাজ করে না ডান হাতও। এই বয়সের আর পাঁচটা ছেলের মতো কথাও বলতে পারে না। রামপুরহাটের বড়শাল গ্রামের সেই শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ই এ বার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪২৭ নম্বর পেয়ে!

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। দেবজ্যোতি মণ্ডল। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। দেবজ্যোতি মণ্ডল। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৫ ০১:৪৯
Share: Save:

জন্মের পর থেকেই ঠিক করে পা ফেলতে পারে না ছেলেটি। দু’ পায়ের বুড়ো আঙুলের উপরে ভর দিয়ে কোনও রকমে দাঁড়ায়। ঠিক মতো কাজ করে না ডান হাতও। এই বয়সের আর পাঁচটা ছেলের মতো কথাও বলতে পারে না। রামপুরহাটের বড়শাল গ্রামের সেই শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ই এ বার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪২৭ নম্বর পেয়ে!

নম্বর যা-ই আসুক, জীবনের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ‘বড়’ হতে চায় দেবজ্যোতি। যদিও দেবজ্যোতির শুরুটা কোনও সাধারণ শিশুর মতো হয়নি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি তার মুখ দিয়ে তাড়াতাড়ি কথাও বের হতো না। এমন ছেলেকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান বাবা-মা। পরে তাঁরা ছেলেকে রামপুরহাট চামড়াগুদাম এলাকায় একটি ‘স্প্যাস্টিক সোসাইটি’তে ভর্তি করেন। পড়াশোনার প্রতি তার জেদ ও ইচ্ছে দেখে পরিবারের লোক জন দেবজ্যোতিকে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করেন। দু’টি স্কুলেই ছেলেকে কোলে করে নিয়ে আসা-যাওয়া করতেন পরিবারের লোক জন। তখন ২০০৪ সাল। সে বছরই ভেলোরে দু’পায়ে অস্ত্রোপচার হওয়ার পরে কৃত্রিম পায়ের উপর ভরসা করে বাড়ির অন্দরে হাঁটাচলার চেষ্টা শুরু করে দেবজ্যোতি। সঙ্গে ছিল দু’রকমের বিশেষ জুতো। ফি বছর ভেলোরে চেকআপ চললেও এখনও দেবজ্যোতিকে কৃত্রিম পায়ের ভরসায় চলাফেরা করতে হয়। সেই ছেলেই তার অদম্য মনের জোরে বড়শাল হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে স্কুলের ছেলেদের মধ্যে প্রথম হয়েছে।

দেবজ্যোতির বাবা মলয় বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০১ সাল পর্যন্ত বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের রামপুরহাট শাখায় ‘মিনি ডিপোজিট স্কিমে’ ডেলি কালেকশন এজেন্টের কাজ করেছেন। কিন্তু, হার্টের দুটো ভালব্ অপারেশন করার পরে আর শারীরিক দিক থেকে জোর পান না মলয়বাবু। সমবায় ব্যাঙ্কের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু, পড়াশোনার প্রতি ছেলের অদম্য মনের জোর দেখে নিজের শারীরিক অবস্থাকে উপেক্ষা করার শক্তি পেয়েছেন মলয়বাবু। তিনি বলছেন, ‘‘গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি করে ছেলেকে রোজ কোলে করে নিয়ে গিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছি। পাছে ছেলে স্কুলে অন্য ছেলের ধাক্কায় পড়ে না যায়, তার জন্য দিনভর সেখানে বসেও থেকেছি।’’ বাবা-মায়ের পরিশ্রমের উপহারও দিয়েছে দেবজ্যোতি। মাধ্যমিকে পেয়েছে ৬৬ শতাংশের বেশি নম্বর!

সাফল্যের এই খবর ছড়াতেই একাদশ শ্রেণিতে দেবজ্যোতির পাশে দাঁড়ায় ‘নতুন সকাল’ নামে সিউড়ির একটি সংস্থা। ওই সংস্থাই দেবজ্যোতির পড়ার যাবতীয় বইপত্র কিনে দেয়। পাশাপাশি দেবজ্যোতিকে পড়ানোর জন্য এগিয়ে আসেন গ্রামের তিন শিক্ষকও। কম সাহায্য করেননি বড়শাল হাইস্কুলের শিক্ষকেরাও। তখনও স্কুল এবং টিউশনিতে ছেলেকে কোলে করে নিয়ে যেতেন দেবজ্যোতির অসুস্থ বাবা। কিন্তু, দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় নতুন করে আর এক প্রতিবন্ধকতা নেমে আসে দেবজ্যোতির জীবনে। উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনার এই প্রবল চাপের মুখেই ডান চোখের কর্ণিয়া নষ্ট হয়ে যায় তার। চিকিৎসার জন্য চার মাস পড়াশোনার জগত থেকে বাইরে থাকতে হয় দেবজ্যোতিকে। কিন্তু, মানসিক জোর এ বারও জিতিয়ে দেয় এই ছেলেকে। উচ্চ মাধ্যমিকে ৪২৭ নম্বর পেয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়ে!

রবীন্দ্র-নজরুল কবিতার আবৃত্তি করতে ভালবাসে দেবজ্যোতি। কীর্তনেরও খুব অনুরাগী। সংস্কৃত নিয়ে পড়ে ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চাই সে। কিন্তু, এ বার তো ঘর নয়। বাইরে কলেজে গিয়ে ছেলে কে পড়তে হবে। কী ভাবে সামাল দেবেন বাবা-মা? সাহায়্যের প্রার্থনা করছেন এই অসম সাহসী ছেলের বাবা-মা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE