Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

উচ্চস্তরে অনুমোদনে মুখে হাসি প্রফুল্লদের

এলাকার স্কুলের জন্য শ্রম দিতে দিতে পরিবার-পরিজন এবং শুভানুধ্যায়ীদের মুখে কেবলই শুনতে হয়েছে, নানা তির্যক মন্তব্য। কিন্তু তবু হাল ছাড়েননি। বরং স্ত্রী’র গহনা, জমির ফসল বিক্রি করে তাঁরা লাগিয়েছিলেন নিজেদের হাতে গড়া স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটির পিছনে। নিজেদের জীবনের সেরা সময়টুকুও নিংড়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের উচ্চস্তরে সরকারি অনুমোদনের খবরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন ওরা।

অনিশ্চয়তা কাটল স্কুলে। — নিজস্ব চিত্র।

অনিশ্চয়তা কাটল স্কুলে। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০১:৩৬
Share: Save:

এলাকার স্কুলের জন্য শ্রম দিতে দিতে পরিবার-পরিজন এবং শুভানুধ্যায়ীদের মুখে কেবলই শুনতে হয়েছে, নানা তির্যক মন্তব্য। কিন্তু তবু হাল ছাড়েননি।

বরং স্ত্রী’র গহনা, জমির ফসল বিক্রি করে তাঁরা লাগিয়েছিলেন নিজেদের হাতে গড়া স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটির পিছনে। নিজেদের জীবনের সেরা সময়টুকুও নিংড়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের উচ্চস্তরে সরকারি অনুমোদনের খবরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন ওরা। ওরা, ময়ূরেশ্বরের মর্জ্যাতপুর হাইস্কুলের একসময়ের সংগঠক শিক্ষক। স্কুলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তথা সংগঠকদের অন্যতম স্বপন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ৬০ শতাংশ তফশীলি জাতি এবং উপজাতি সম্প্রদায়ের। অন্যস্কুলে ভর্তির হয়রানি এবং দূরত্বের কারণে ওইসব ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ স্কুলছুট হয়ে যেত। এবার থেকে ওই প্রবণতা দূর হবে।’’

১৯৭৪ সালের কথা। সেসময় ৪/৫ কিমির মধ্যে এলাকায় কোনও উচ্চশিক্ষার স্কুল ছিল না। দূরের স্কুলগুলিতেও স্থানাভাবের কারণে প্রাথমিকের পর পড়ুয়া বিশেষত প্রত্যন্ত এলাকার পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হত। এলাকার কয়েকজন বেকার যুবক বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। তাঁরাই প্রায় তিনশো পড়ুয়া নিয়ে স্থানীয় বাউলতলা আশ্রমে শুরু করেন সংগঠিত জুনিয়ার হাই স্কুল। ১৯৯৭ সালে জুনিয়র হাই স্কুলের স্বীকৃতি লাভ করে সেই স্কুল। তৈরি হয় প্রাচীর ঘেরা দোতলা ভবন। আর সম্প্রতি মিলেছে মাধ্যমিক স্তরের অনুমোদন। তাতে সবমহলে বইছে খুশির হাওয়া।

এ স্কুলের চলার পথ এতটাও মসৃণ ছিল না। বরং বহু চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। স্কুলের জন্য প্রায় ১ একর ৩৪ শতক জমি দান করেন স্থানীয় পাল পরিবারের সর্বেশ্বর পাল, বিশ্বনাথ পাল, ভুবনেশ্বর পালরা। উদ্যোক্তারা সেই জমির উপর নিজেদের যথা সর্বস্বের পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে বাঁশ, খড় ভিক্ষা করে তৈরি করেন কাদাছিটের স্কুল বাড়ি।

স্কুল বাড়ি নির্মাণ হলেও, সে বাড়ির উপর নানা সময় দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছে। কখনও বন্যায় ভেঙে পড়েছে স্কুলবাড়ি তো কখনও ঝড়ে উড়ে গিয়েছে তার চাল। কখনও তদানীন্তন শাসকদলের রক্তচক্ষু বিপন্ন করেছে স্কুলের অস্তিত্ব। তাই দেখে পরিবারের লোকেরাও ‘ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরে’ আসার পরামর্শ দিয়েছেন। হতাশা এবং অবসাদ্গ্রস্থ হয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছেন শিক্ষকদের একাংশ। তবুও কয়েকজন সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে বছরের পর বছর ধরে স্কুল চালিয়েছেন।

সে দিনের সেই উদ্যোক্তাদের অনেকেই অবশ্য আজ অবসর নিয়েছেন। কিন্তু স্কুলের উচ্চস্তরে অনুমোদনের খবরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে প্রফুল্ল পাল, ধ্বজাধারী মণ্ডল, দিবাকর পালরা জানালেন, জীবনের সেরা সময় এবং সর্বস্ব দিয়ে আমরা স্কুল গড়েছিলাম। কোনওদিন ভাবিনি, সরকারি অনুমোদন মিলবে। চাকরি জীবনের প্রায় শেষ লগ্নে শিক্ষক হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু আজ সেই স্কুল মাধ্যমিকের অনুমোদন পাওয়ায় আমাদের সব প্রত্যাশা পূর্ণ হয়ে গেল। এতে উচ্চ শিক্ষার প্রবণতাও বাড়বে।

স্কুলের এই উচ্চস্তরে অনুমোদনে খুশি ছাত্রছাত্রীরাও। নবম শ্রেণির মনিকা সোরেন, লক্ষী মুর্মর কথায়, ‘‘আর আমাদের অষ্টম শ্রেণির পর অন্য স্কুলে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি করতে হবে না। নিজেদের স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারব।’’ দুর্ভোগ ঘুচল বলছেন অভিভাবকরাও। অভিভাবক সূর্যকান্ত পাল, সঞ্জীব মণ্ডলরা বলেন, ‘‘এতদিন আমাদের অন্য স্কুলে নবম শ্রেণির ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাতে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এবার থেকে সেই ভোগান্তি ঘুচল।’’

স্কুল পরিচালন কমিটির সম্পাদক সুশান্ত পাল বলেন, ‘‘স্কুলের পরিকাঠমোর উন্নয়নের জন্যও সাংসদ তহবিল-সহ বিভিন্ন সরকারি অনুদানেরও ব্যবস্থা হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

school mayureshwar teacher ornament madhyamik
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE