কুলার কিনে ঘরের পথে। বাঁকুড়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
রোদের ঝাঁঝের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাসিটা চওড়া হচ্ছে ওঁদের।
—হবে নাই বা কেন?
গত বছরে যে পরিমাণ ব্যবসা হয়েছিল, এপ্রিলের শুরুতেই তার দ্বিগুণ ব্যবসা হয়ে গিয়েছে যে!
শুধু তাই নয়, এপ্রিলের গোড়া থেকে দাবদাহের জেরে বিক্রি এতটাই বেড়েছে যে চলতি মাসের শেষে এখন কুলার, এসি এখন বাড়ন্ত! ভিড় সামল দিতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একশা দোকানের মালিকেরা হাতজোড় করে ক্রেতাদের বলছেন— ‘হয় ধৈর্য ধরুন, নয় অন্যত্র দেখুন!’
কথা হচ্ছিল সতীঘাট রামমন্দির সংলগ্ন একটি দোকানের মালিক রাজু মুশিবের সঙ্গে। বিক্রিবাটার প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, “সত্যিই আর পেরে উঠছি না! এই একমাসে ক্রেতা সামলাতে সামলাতে নাজেহাল হয়ে গিয়েছি। চাহিদা এতটাই যে জোগান দিতে পারছি না। বহু ক্রেতাই মাল না পেয়ে বরাত দিয়ে যাচ্ছেন।”
কতটা বেড়েছে বিক্রি?
রাজুবাবু জানাচ্ছেন, চলতি মাসেই তিনি ৩০০-এর বেশি কুলার ও ১৫০ এসি বিক্রি করেছেন। কবুল করছেন— গত বছর এর অর্ধেকেরও কম ব্যবসা হয়েছিল। আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ছবিটা কমবেশি একই।
এমনিতে জেলায় মে মাস থেকে দাবদাহ শুরু হয়। ওই সময়ে এসি, কুলারের বিক্রি বেড়ে যায়। কিন্তু এ বার এপ্রিলের গোড়া থেকেই দাবদাহে নাজেহাল মানুষজন ঠান্ডা বাতাসের খোঁজে ছুটছে ইলেক্ট্রনিক্স দোকানগুলিতে। অন্যবার প্রাক গ্রীষ্মকালীন বাজার ধরতে এপ্রিলে নানা অফার দেয় এসি, কুলার নির্মাণকারী সংস্থাগুলি। এ বার তারও বালাই নেই। ব্যবসায়ীদের কথায়, “অফার তো নেই। তা ছাড়া গ্রাহকদের অফার দেখার ফুরসত কই। গরমে অতিষ্ঠ ক্রেতাদের শুধু একটাই দাবি, হাওয়া ঠান্ডা হওয়া চাই।”
এমনই এক দোকানে দেখা মিলল দোলতলার বাসিন্দা হারু আশমোদকের। কুলার নেই শুনে হতাশ হলেন তিনি। শহরেরই একটি আবাসনের বাসিন্দা শিবানন্দ মজুমদার আগাম বরাত দিয়ে যাওয়ায় একটি কুলার পেয়েছেন। শিবানন্দবাবু বলেন, “বাঁকুড়ার শুষ্ক গরমে কুলার বেশ আরাম দায়ক হবে। আরও আগেই কিনতাম। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না।”
ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন শহরের স্কুলডাঙার ইলেক্ট্রনিক্স দোকানের কর্মীরাও। একটি দোকানের মালিক প্রশান্ত মণ্ডল বলেন, “অভাবনীয় ব্যবসা হয়েছে এ বার। গতবারের তুলনায় অনেক বেশি কুলার ও এসি বিক্রি হয়েছে। ক্রেতারা এসে ফিরে যাচ্ছেন। আমরাই জোগান দিতে পারছি না।”
এই দোকানেই এসি কিনতে এসেছিলেন শহরের শুভঙ্কর সরণির প্রবীণ বাসিন্দা কমল মহাপাত্র। তিনি বলেন, “তিন দিন ধরে এসির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছি। কিন্তু মাল নেই। যা গরম তাতে এসি ছাড়া বাড়িতে টেকাই দায়।” কথার ফাঁকেই প্রশান্তবাবুর দোকান থেকে একটি টোটো গাড়িতে করে দু’টি এসি পাঠিয়ে দেওয়া হল তালড্যাংরার উদ্দেশে। দু’জন কর্মীও গেলেন এসি ‘ফিট’ করতে। দোকানের কর্মীরা জানাচ্ছেন, বুকিং করে রেখেছিলেন তালড্যাংরার দুই ক্রেতা। মাল আসতেই পাঠিয়ে দেওয়া হল।
শুধু বাঁকুড়া শহর নয়, জেলার অন্য ব্লক শহরের দোকানগুলিতেও একই অবস্থা। বড়জোড়ার শিবতলা রোডের একটি ইলেকট্রনিক্স দোকানের মালিক রবিন গোস্বামী জানাচ্ছেন, চলতি মাসে মোট ৩৫টি এসি ও ২৬টি কুলার বিক্রি করেছেন তিনি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাই-স্পিড ফ্যানের চাহিদাও। তিনি বলেন, “মানুষ দোকানে আসছেন আর দ্রুত বাড়িতে এসি ফিট করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু কোম্পানিগুলি চাহিদা মতো মাল সাপ্লাই দিতে না পারায় বহু ক্রেতাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।” বড়জোড়া থানাপাড়ার গৃহবধূ শম্পা ভট্টাচার্য বলেন, “ছেলে নতুন চাকরি পেয়ে বাইরে গিয়েছে। এখানে তীব্র গরম পড়েছে শুনেই এসি লাগানোর জন্য জোরাজুরি শুরু করেছে। টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছে।”
তীব্র গরমের মোকাবিলায় এসি-কুলারের দিকে ঝুঁকছেন এমন অনেকে জানাচ্ছেন, বহু কষ্ট করে হলেও ওই টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। অনেকে সাহায্য নিচ্ছেন ইএমআইয়েরও। ধার করতেও পিছপা হচ্ছেন না অনেকে। এঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘ধার করে ঘি না খেয়ে আর উপায় কি? প্রাণটা তো বাঁচাতে হবে!’’
জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত ব্লক সিমলাপালের এক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, তাঁর দোকান থেকে এপ্রিল মাসেই দু’শোর বেশি কুলার ও এসি বিক্রি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যবসায়ী বলেন, “গত কয়েক বছর ধরেই কিছু কিছু করে কুলার ও এসি বিক্রি শুরু হয়েছিল। এ বার এসি, কুলার কিনতে দোকানে লম্বা লাইন পড়ছে যাচ্ছে ক্রেতাদের।”
একটি বিনিয়োগকারী সংস্থার কলসালট্যান্ট সৌমিত্র পাঠক জানাচ্ছেন, বিক্রি অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় এসি, কুলার নির্মাণকারী কোম্পানিগুলির শেয়ারের দামও চড়ে গিয়েছে অনেকটা। ফলে লাভবান হয়েছেন এই সব সংস্থার শেয়ারে লগ্নিকারী মানুষজনও। এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে গিয়ে কোনও সংস্থার শেয়ারের মূল্য (এনএভি) ১১৪৭ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪০৮, আবার কোনওটির ২১৮৪ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৬৪।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy