Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

মহালয়ায় নিমেষে শেষ আনন্দমেলার ভাঁড়ার 

মহালয়ার ভোরে শান্তিনিকেতনের ঘুম ভাঙাল গৌরপ্রাঙ্গণের ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের সুর। ফি বছরের মতো এ বারও রীতির অন্যথা হয়নি।

অতিথি: আনন্দমেলায় বিকিকিনি। সোমবার গৌরপ্রাঙ্গণে। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

অতিথি: আনন্দমেলায় বিকিকিনি। সোমবার গৌরপ্রাঙ্গণে। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

দেবস্মিতা চট্টোপাধ্যায়
শান্তিনিকেতন শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ০৭:৩০
Share: Save:

মহালয়ার ভোরে শান্তিনিকেতনের ঘুম ভাঙাল গৌরপ্রাঙ্গণের ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের সুর। ফি বছরের মতো এ বারও রীতির অন্যথা হয়নি।

ভোর চারটে থেকে গৌরপ্রাঙ্গণে গিয়ে ‘আনন্দবাজার’-এর জন্য মাঠ সাজান পড়ুয়ারা। এর মাঝে যত বার ঢাকে কাঠি পড়েছে, ঢোল বেজেছে, এক ঝলক রাঙামাটির ধুলো উড়িয়ে এসে আবার স্টল সাজানোর কাজে লেগেছেন। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতেই নিজেদের হাতে তৈরি খাবার, হস্তশিল্পের পসার নিয়ে তৈরি ছিল শিশুবিভাগ থেকে শুরু করে গবেষক ছাত্রছাত্রীরা। ১০ টাকার ফুচকাও এ দিন অনায়াসে ২০ টাকায় বিক্রি হয়ে যায়। পাঁচ টাকার চায়ের দাম হয় দশেরও বেশি। তবু সব বিক্রি হয়ে যায়। এর পর একে একে সব বিক্রি হয়ে যেতেই থালা বাজিয়ে, ঢাকের তালে, সারিবদ্ধ হয়ে নাচ। কিছুটা এ ভাবেই ‘আনন্দবাজারের’ মধ্যে দিয়ে মহালয়া পালিত হল বিশ্বভারতীতে।

মহালয়ার দিনে এক দিনের এই মেলা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও মত পাওয়া যায় না। জানা যায়, ১৩২৪ বঙ্গাব্দে নববর্ষের দিনে শান্তিনিকেতনে ছেলেদের আনন্দমেলা হয়েছিল। এর পরের বছর পৌষমেলার সময় হয় ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা এই মেলার আয়োজন করতেন। রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকাকালীন এক বার গরমের ছুটির আগেও এ রকম একটি মেলা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। পরে দেশ-বিদেশের আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা যখন দুর্গাপুজোর আগে বাড়ি যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠতেন, তার আগে তাঁদের আনন্দ দেওয়ার জন্য শুরু হয় এই আনন্দবাজার। এখন যদিও ‘আনন্দমেলা’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এই মেলা।

প্রথম দিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের পড়ুয়াদের নিয়ে শুরু হওয়া এই মেলায় এখন বিশ্বভারতীর প্রায় প্রতিটি ভবনের প্রতিটি বিভাগের প্রতিটি বর্ষের পড়ুয়ারা যোগ দেন। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হল, বিকিকিনির মধ্যে দিয়ে যে লাভের টাকা পাওয়া যায় তা জমা পড়ে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে ছাত্র কল্যাণমূলক কাজে এই টাকার ব্যবহার করা হয়।

আনন্দবাজারের দিনে চিরাচরিত নামে চিনে আসা খাবারের পদগুলি পরিচিতি পায় সম্পূর্ণ অন্য নামে। স্টলের নাম এমন হতে হবে যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করবে কিংবা খাবারের নাম এমন হতে হবে, যাতে করে নাম শুনেই খেতে মনে হবে। প্রতি বছরই এ রকম বহু নতুনত্বের সাক্ষী থাকে বিশ্বভারতীর আনন্দবাজার। এ বছরও ‘পেটুক’, ‘খাই-খাই’, ‘বিনায়ক’, ‘মিড-ডে মিল’ এমন কত নামের স্টল বসেছিল আনন্দবাজারে। সেখানে পসরারও প্রাচুর্যও ছিল। দর্শনার্থী স্বাগতম বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এক সময় নিজে ছাত্র ছিলাম। এখন প্রাক্তনী। এই মেলা যে পড়ুয়াদের কাছে কতটা আবেগের সেটা জানি। বিশেষ করে পাঠশালার বাচ্চারা খুব আনন্দ করে। ওরা যে দিকে স্টল দেয়, সে দিকে এক বার গেলে রক্ষে নেই। সব যেন পাকা ব্যবসায়ী। জিনিস কিনিয়েই ছাড়বে।’’ এ সবের মাঝেই নিমেষে শেষ হল আনন্দমেলার ভাঁড়ার। বিকেল চারটে থেকে রাত আটটা— তাতেই শেষ বিকিকিনি।

বর্তমান পড়ুয়াদের মধ্যে অমিত গড়াই, স্বরূপ মল্লিক, বাবুরাম মুর্মু, নিশা পাল, শ্রীদাত্রী দাস মহাপাত্র, সায়ন্তন মণ্ডলদের কথায়, ‘‘আমরা ভোর থেকেই স্টল সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আগের দিন রাতেও কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখি। সব বন্ধুদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নিই আমরা। যে যার দায়িত্ব পালন করে।’’ প্রবীণ আশ্রমিক স্বপনকুমার ঘোষ বললেন, ‘‘মহালয়ার দিনে বিশ্বভারতীর এই প্রাচীন মেলার আজও একটি ঐতিহ্য ও আদর্শ আছে। মেলার কর্তৃত্ব একেবারেই ছাত্রছাত্রীদের। নেপথ্যে থাকেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এই মেলার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশিয়ানার পরিচয় পাই।’’ প্রায় প্রতি বছরই আনন্দমেলায় ঢাক সহ অন্য বাদ্যযন্ত্র বাজাতে আসেন বল্লভপুর দাসপাড়ার রামপ্রসাদ দাস, আশিস দাস, দুলাল দাসেরা। তাঁরা জানালেন, এই মেলা না পেরোনো পর্যন্ত তাঁরা এলাকা ছেড়ে কোথাও যান না। এ ভাবেই পরম্পরা মেনে, আবেগের স্পর্শে আজও চিরন্তন হয়ে আছে মহালয়ার দিনে বিশ্বভারতীর আনন্দবাজার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anandabazar Patrika Anandamela Stock Mahalaya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE