E-Paper

‘কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, কেউ একেবারে চুপ’

রবিবার রঘুনাথপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে শুয়ে ওড়িশার বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনার কথা মনে করে রীতিমতো শিউরে উঠছিলেন রঘুনাথপুর ২ ব্লকের বড়রা গ্রামের গৌরাঙ্গ বাউরি।

নিজস্ব সংবাদাদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৩ ১০:০০
রঘুনাথপুর ও বিষ্ণুপুর সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র

রঘুনাথপুর ও বিষ্ণুপুর সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র

কিছু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। দ্রুত গতিতে ছুটছে ট্রেন। আচমকা বিকট কান ফাটানো আওয়াজ। সঙ্গে তীব্র ঝাঁকুনি। তার পরে আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান যখন ফেরে, অন্ধকারে চারদিকে শুধু আর্তনাদ আর কান্নার শব্দ।

রবিবার রঘুনাথপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে শুয়ে ওড়িশার বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনার কথা মনে করে রীতিমতো শিউরে উঠছিলেন রঘুনাথপুর ২ ব্লকের বড়রা গ্রামের গৌরাঙ্গ বাউরি। তিনি বলেন, “ঘটনার পরে স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে উদ্ধারকাজ শুরু করেছিলেন। তাঁদের আনা আলোতে দেখি রেললাইন ও আশপাশে ছড়িয়ে কত যাত্রী। কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, কেউ একেবারে চুপ।” এর পরে তাঁকে ভর্তি করানো হয় বালেশ্বরের হাসপাতালে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে সেখান থেকে বাস ধরে খড়্গপুরে আসেন গৌরাঙ্গ। সেখান থেকে ট্রেনে পৌঁছন আদ্রায়। সেখানে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে এসে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। পাশে থাকা স্ত্রী ময়না বলেন, “ভাগ্য ভাল বাড়ি ফিরতে পেরেছে। ক’টা বাড়তি টাকার জন্য আর বাইরে কাজ করতে যেতে দেব না।”

ওড়িশায় ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়া পুরুলিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে রবিবার জেলায় ফিরেছেন বাঘমুণ্ডির হরিডি গ্রামের লালু বাউরি, মাদলা গ্রামের গোবিন্দ সিংলায়া ও বোরো থানার মাঝিরডি গ্রামের বিকাশ মাহাতোও। এদের মধ্যে গোবিন্দ ও বিকাশ ভর্তি আছেন পুরুলিয়া মেডিক্যালে। বিকাশ ছাড়া বাকিরা যশবন্তপুর-হাওড়া হামসফর সুপারফাস্টে বাড়ি ফিরছিলেন।

সামান্য চোট পাওয়া লালু বাড়িতেই রয়েছেন। ওড়িশার সোরো হাসপাতালে থাকার সময়ে ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লালুর কথায়, “হঠাৎই ফোনটা আসে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, মুখ্যমন্ত্রী কথা বলবেন। উনি আমার শারীরিক অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন। পরে কোথায় বাড়ি জানতে চান। বাঘমুণ্ডিতে বাড়ি শুনে জানতে চেয়েছিলেন, অযোধ্যা পাহাড়ের বাসিন্দা কি না। সব শুনে আশ্বস্ত করেছিলেন, সরকার আমাদের পাশে আছে।”

ওই রাতের অভিজ্ঞতা জীবনে ভোলার নয়, জানাচ্ছিলেন বিকাশও। শুক্রবার ভদ্রক থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেস ধরেছিলেন তিনি। বিকাশের কথায়, “আচমকা তীব্র আওয়াজ আর ঝাঁকুনি। আসন থেকে ছিটকে পড়ি। লোকজন উদ্ধার করে ভর্তি করায় হাসপাতালে।” তিনি জানান, কটক হাসপাতালে থেকে ছাড়া পেয়ে ওড়িশা সরকারের ঠিক করে দেওয়া বাসে পৌঁছন ঝাড়খণ্ডের জামসেদপুর। সেখান থেকে রবিবার সকাল ১০টায় পৌঁছন পুরুলিয়ায়।

বাঘমুণ্ডির গোবিন্দ ও লালুর সঙ্গে ঘটনার দিনই যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন পরিবারের লোকজন। বাঘমুণ্ডি থেকে গাড়িতে পৌঁছে যান সোরো হাসপাতালে। রবিবার সকালে বাড়ি পৌঁছেছেন দু’জন। করমণ্ডল এক্সপ্রেসে থাকা বান্দোয়ান থানা এলাকার সাত শ্রমিকের মধ্যে পাঁচ জনের সঙ্গেও যোগযোগ করতে পেরেছে পরিজনেরা। চার জন কটকের হাসপাতাল ও এক জন বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি রয়েছেন। এ দিন পুরুলিয়া মেডিক্যালে গিয়ে গোবিন্দ ও বিকাশের সঙ্গে দেখা করেন পুরুলিয়ার জেলাশাসক রজত নন্দা ও জেলা পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। রঘুনাথপুরে যান মহকুমাশাসক তামিল ওভিয়া এস। পরে, বাঘমুণ্ডির বিধায়ক সুশান্ত মাহাতো ও পাড়ার বিধায়ক নদিয়ারচাঁদ বাউরিও দুই হাসপাতালে ভর্তি থাকা তিন জনের সঙ্গেদেখা করেন।

দুর্ঘটনার শিকার বিষ্ণুপুরের জয়কৃষ্ণপুরের পাত্রবাঁকড়ার বাসিন্দা সেনা জওয়ান গোবিন্দ মাকুড়ের স্ত্রী মৌসুমী জেলায় ফিরে এ দিন বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশালিটিতে ভর্তি হয়েছেন। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বি-৫ কামরায় তাঁরা পরিবারের পাঁচ সদস্য চেন্নাই রওনা দিয়েছিলেন। মৌসুমী বলছিলেন, “পেট থেকে শরীরের নীচের অংশ লোহার কাঠামোয় চাপা পড়েছিল। গোটা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। হাত দুটো তখনও কাজ করছে। চারদিকে খোঁজ করছি মেয়ের। আচমকা কান্না শুনতে পেলাম কিন্তু চোখে দেখতে পাইনি। সিটের ভেতর চাপা পড়ে থাকা মেয়ের হাতটা দেখতে পেলাম। মেয়ের কাছে যেতে চাইলেও পারিনি।” পরে, গোবিন্দ কোনও ভাবে লোহার কাঠামোর নীচ থেকে বেরিয়ে এসে একে একে সকলকে বের করেন।

করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ১৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের একটি দলও চেন্নাই রওনা দিয়েছিলেন। দলে ছিলেন সারেঙ্গার বাসিন্দা কাঞ্চন দুলে ও তাঁর পিসতুতো ভাই অভয় দুলে। কাঞ্চন বলেন, “জেনারেল কামরায় সিট না পেয়ে হাতল ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ বগি পাল্টি খেল। জানলার পাশে বসে থাকা এক যাত্রী মাটি দেখলাম ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন। আমরা হাতল ছাড়িনি। ইমার্জেন্সি জানালা বেয়ে উপরে উঠে ট্রেন থেকে বেরোই।”

কার্যত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজের ছাত্রী, রাইপুরের তিন যুবতী রিয়া রায়, রূপালি চট্টোপাধ্যায় ও পায়েল দে-ও। যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্টের যাত্রী রিয়া বলেন, “দাদার বিয়ে বলে ছুটি নিয়ে বাড়ি আসছিলাম। এমন বিপত্তি হবে ভাবিনি। ঘটনার পরে একটি বগিতে আগুন লাগে। আগুনের ফুলকি আমাদের বগির জানালা দিয়েও ঢুকছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের বগিটি পাল্টি খাওয়ায় ইমার্জেন্সি গেট দিয়ে বেরোনো সহজ হয়ে যায়। সেখান দিয়ে বেরিয়ে বগির ছাদে উঠে লাফিয়ে নীচে নেমেছিলাম।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Coromandel Express accident Raghunathpur Train accident Balasore

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy