স্মৃতি: জোড়বাংলা মন্দিরের চাতালে চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত। ফাইল ছবি
নব্বই পেরিয়েও চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখছিলেন আরও একটি গবেষণা গ্রন্থ। বিষয় ছিল, ভারতের শিল্প-সংস্কৃতিতে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরের গুরুত্ব। সেই গ্রন্থ অপ্রকাশিত রেখে চলে গেলেন বিষ্ণুপুরের ‘জীবন্ত ইতিহাস’ বলে কথিত চিত্তরঞ্জনবাবু। বুধবার দুপুরে বিষ্ণুপুর হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ৯৬ বছর বয়সে এই পুরাতত্ত্ববিদের মৃত্যু হয়। রেখে গেলেন স্ত্রী, একমাত্র ছেলে-সহ পরিজনদের।
পরিজনেরা জানাচ্ছেন, পরিবারে একের পরে এক ঘনিষ্ঠের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। সম্প্রতি এক ভাইয়ের মৃত্যুতে তিনি যে ধাক্কা পেয়েছিলেন, তা আর সামলাতে পারলেন না। ৩১ জুলাই তাঁকে বিষ্ণুপুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি।
এ দিন তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে বিষ্ণুপুর তো বটেই, রাঢ়বঙ্গের ইতিহাসপ্রেমীরাও শোকস্তব্ধ। ছাত্রাবস্থা থেকে আজন্মকাল তিনি সাবেক মল্লভূম তথা বিষ্ণুপুরের ইতিহাসের খোঁজে জীবন কাটিয়েছেন। তাই তাঁর মৃত্যুতে শোকার্তরা বলছেন—‘বিষ্ণুপুরের জীবন্ত ইতিহাস’ চলে গেলেন।
বিষ্ণুপুর হাসপাতাল থেকে তাঁর দেহ প্রথমে বিষ্ণুপুর হাইস্কুল, আচার্য যোগেশ্চন্দ্র পুরাকৃতি ভবন, নিখিলবঙ্গ শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় হয়ে বিষ্ণুপুরের কবিরাজপাড়ায় তাঁর বাসভবনে যায়।
স্কুলশিক্ষক মানিকলাল সিংহের হাত ধরে ইতিহাস খুঁজতে নেমেছিলেন কৈশোরে। মাটি খুঁড়ে বিষ্ণুপুরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে খুঁজে আনাই তাঁর জীবনের ব্রত হয়ে উঠেছিল। বিষ্ণুপুর হাইস্কুলের শিক্ষক হলেও নেশা ছিল পুথি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধারে। তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম—‘বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা’, ‘ভারতের শিল্প সংস্কৃতির পটভূমিকায় বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা’, ‘দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের মূর্তিশিল্প ও সংস্কৃতি’। অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে পেয়েছেন ‘রাখাল দাস স্মৃতি পুরস্কার’।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চিত্তরঞ্জনবাবুর স্ত্রী সুষমা দাশগুপ্ত বলেন, “আমাদের ৫৫ বছর বিয়ে হয়েছে। একটা দিনের জন্যও পুথি আর পুরাতত্ত্ব ছাড়া থাকেননি। মাঝে মাঝে বিরক্ত হতাম। তবে পরে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। অসুস্থ শরীরেও ছুটে যেতেন আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনে। সেটাই যেন তাঁর আসল আস্তানা। বয়স হলেও বাঁচার আকাঙ্ক্ষা ছিল অদম্য। কিন্তু একের পরে এক আত্মীয়-পরিজনের মৃত্যু সহ্য
করতে পারলেন না। একটি অপ্রকাশিত গ্রন্থের অতৃপ্তি নিয়েই তাঁকে চলে যেতে হল।”
আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের আমৃত্যু সদস্য সচিব ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। সেখানে থরে থরে সাজানো বিষ্ণুপুরের বহু নিদর্শন। যাঁর অনেকগুলিই চিত্তরঞ্জনবাবু ও তাঁর সঙ্গীদের উদ্ধার করা। ওই সংগ্রহশালার ‘কিউরেটর’ তুষার সরকার জানান, মানিকলাল সিংহের নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-এর বিষ্ণুপুর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে। তিনি বলেন, ‘‘এই সংগ্রহশালা গড়ে ওঠার সাক্ষী ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। তাঁর মৃত্যুতে রাঢ়বঙ্গের পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চার একটি যুগের অবসান হল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy