Advertisement
E-Paper

ঘর সারিয়ে ওষুধ এনে দিচ্ছে গ্রামেরই ছাত্র, যুবকেরা

ফুল্লবাবুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন গ্রামের বারো জন ছাত্র ও যুবক।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০৮:০০
রঘুনাথপুর ১ ব্লকের চিনপিনা গ্রামে প্রফুল্ল রজক ও সিন্ধু রজকের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

রঘুনাথপুর ১ ব্লকের চিনপিনা গ্রামে প্রফুল্ল রজক ও সিন্ধু রজকের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

এক কালে একান্নবর্তী পরিবার ছিল। এখন এক চিলতে ঘরে থাকেন দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। সম্পর্কে দেওর ও বৌদি। বর্ষার শুরুতে আরও বেহাল হয়ে পড়েছিল ভগ্নপ্রায় ঘর। খড়ের চাল নষ্ট হয়ে জল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পাশে দাঁড়ালেন গ্রামেরই কিছু ছাত্র ও যুবক। নিজেরাই টাকা দিয়ে সংস্কার করেছেন ঘরের। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে করেছে ওষুধের ব্যবস্থা। বাকি টাকায় চাল, ডাল কিনে দিয়েছেন।

মানবিকতার এমন নজির দেখল রঘুনাথপুর ১ ব্লকের খাজুরা পঞ্চায়েতের চিনপিনা গ্রাম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাহায্যে এগিয়ে আসা গ্রামের যুবক পার্থ পরামানিক, সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন দেওঘরিয়া, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋজু চট্টোপাধ্যায়, সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘প্রফুল্লদাদুর গড়া মূর্তি নিয়েই আমরা সরস্বতী পুজো করেছি। এখন উনি মূর্তি গড়তে পারেন না। বড় কষ্টে দিন কাটে ওঁদের। বর্ষার শুরুতেই ছাদ ভেঙে বাড়িটা জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। দেখে খুব খারাপ লাগছিল। তাই টাকা জোগাড় করে ঘর মেরামত করে যতটা পারি সাহায্য করেছি।”

চিনপিনা গ্রামের পঁচাশি বছরের প্রফুল্ল রজক ও সিন্ধু রজক সম্পর্কে দেওর-বৌদি। প্রফুল্লবাবুর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে পনেরো বছর আগে। সিন্ধুদেবীর স্বামী বছর তিরিশ আগে মারা যান। দু’জনেরই একটি করে মেয়ে ছিল। বিয়ে হয়ে তাঁরা এখন গ্রামের বাইরে। বয়সের ভারে অশক্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দিন কাটে প্রফুল্লবাবুর বার্ধক্য ভাতার সামান্য ক’টা টাকা সম্বল করে।

প্রফুল্লবাবুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন গ্রামের বারো জন ছাত্র ও যুবক। তাঁদের মধ্যে শুধু পার্থ পরামানিক কাজ করেন। রঘুনাথপুরের একটি পানীয় জল তৈরির ছোট সংস্থায়। অন্যরা সবাই এলাকার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্র। নিজেদের হাতখরচ বাঁচিয়েই জোগাড় করেছিলেন হাজার পাঁচেক টাকা। নতুন খড় আর বাঁশ কিনে মেরামত করেছেন প্রফুল্লবাবুর ঘরের ভেঙে পড়া খড়ের ছাদ। মাটি কিনে সারাই করেছেন ভেঙে পড়া দেওয়াল। পার্থ জানান, মেরামত করতে করতেই নজরে আসে দু’জনেই অসুস্থ। জ্বর হয়েছে। রঘুনাথপুরে এসে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। বেঁচে যাওয়া টাকায় কিনে নিয়ে যাওয়া হয় কিছু চাল, ডাল।

চিনপিনা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, প্রফুল্লবাবুর ঘরের চালে উঠে খড় চাপাচ্ছেন কেউ। কেউ দেওয়ালে মাটি লেপছেন। কানে খুবই কম শোনেন প্রফুল্লবাবু ও সিন্ধুদেবী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মেয়েদের দূরে বিয়ে হয়েছে। এখন কেউ আর সে ভাবে যোগাযোগ রাখে না। অশক্ত শরীরে তাঁরা বিশেষ কাজও করতে পারেন না। প্রফুল্লবাবু বলেন, ‘‘কোনও মাসে সাতশো আবার কোনও মাসে আটশো টাকা বার্ধ্যকভাতা পাই। ওটাই দু’জনের সম্বল।”

একটা সময়ে মাটির মূর্তি গড়তেন প্রফুল্লবাবু। তাঁর গড়া মূর্তিতেই গ্রামে হত সরস্বতী পুজো, মনসা পুজো, ভাদু পুজো। এখন হাত কাঁপে। চোখেও ভাল দেখেন না। বছর পাঁচেক হল বাধ্য হয়েই মূর্তি গড়া ছেড়েছেন। ওই ছাত্র-যুবকেরা জানান, দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখে নিজেরাই এক দিন আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিছু করতে হবে। পার্থ বলেন, ‘‘আমরা কেউই প্রচুর রোজগার করি না। তাই অনেক কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও টাকার অভাবে সবটা করে উঠতে পারিনি। নিজেরাই সাধ্য মতো চাঁদা দিয়ে হাজার পাঁচেক টাকা জোগাড় করে যতটা পারি করেছি।” তবে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ বার থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আরও কিছু প্রয়োজন হলেই সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেবেন। দু’জন কেন সরকারি সাহায্য পাননি, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

বাড়ি তৈরির জন্য বাংলার আবাস যোজনা, স্বল্প অর্থে চাল-গম পাওয়ার জন্য অন্নপূর্ণা অন্ত্যোদয় যোজনার মতো অনেক প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু ওই দু’জন বার্ধক্য ভাতা ছাড়া অন্য প্রকল্পের সুযোগ পান না বলে দাবি করেছেন। সিন্ধুদেবী বলেন, “বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সব দলের লোককেই বলেছি। আশ্বাস ছাড়া কেউ কিছুই দেয়নি।” ওই দু’জনের যে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া উচিত ছিল, সে কথা মানছেন গ্রামের বিদায়ী পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের চৈতন বাউড়িও। তিনি বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। সাহায্য পাওয়াটা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিপিএল তালিকায় তাঁদের কারও নামই না থাকায় আমরা চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি।”

সামান্য বার্ধ্যকভাতা যাঁদের সম্বল, তাদের নাম কেন নেই বিপিএল তালিকায়? উত্তর মেলেনি পঞ্চায়েত সদস্যের কাছ থেকে।

Humanity Purulia Voluntary work
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy