গ্রামের মূল রাস্তায় ঢুকতেই পাথর দিয়ে তৈরি ক্যাকটাস আকৃতির ভ্যাট। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
নিষেধের ফতোয়া ছিল না। কিন্তু স্বেচ্ছায় নিয়ম মেনে নজির গড়ল খয়রাশোলের কদমডাঙা।
জেলায় পুর এলাকায় ইতিমধ্যেই প্লাস্টিক ব্যবহারে বিধি-নিষেধ জারি করেছে পুরসভাগুলি। নিয়ম না মানলে পুরশহরের বাসিন্দাদের মতো গ্রাম-এলাকায় এখনও জরিমানা হওয়ারও ভয় নেই। তবু, নিজেদের স্বার্থে, প্রকৃতির স্বার্থে প্লাস্টিক-মুক্ত গ্রাম গড়ে নজির গড়ল কদমডাঙা। তারা ঠিক করেছে, প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করবে না। পাশে দাঁড়াল প্রশাসন।
শনিবার ওই গ্রামে গিয়ে গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের কর্মকাণ্ডের নমুনা দেখেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী।
তিনি বলেন, ‘‘স্বচ্ছ ভারত মিশনের আওতাধীন নির্মল বাংলা অভিযান কর্মসূচিকে সফল করতে খয়রাশোল ব্লক প্রথম সারিতে। এবং এটাই জেলার একমাত্র গ্রাম, যে গ্রাম প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের জন্য সত্যিকারের তাগিদ অনুভব করেছে।’’
ঠিক কী করেছে এই গ্রাম?
খয়রাশোলের বাবুইজোর পঞ্চায়েতের ওই গ্রামে গেলেই বোঝা যায়, গ্রামে ঢোকার মূল রাস্তার সামনে বাসযাত্রী প্রতীক্ষালয়। সেই প্রতীক্ষালয়ের দেওয়ালে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের অঙ্গীকার। দেওয়ালের অন্য পিঠে প্লাস্টিক নিয়ে ঠিক কি কি কর্মকাণ্ড হয়েছে— পুরো ম্যাপ তৈরি সেটা দেখানো হয়েছে। গ্রামের মূল রাস্তায় ঢুকতেই পাথর দিয়ে তৈরি ক্যাকটাস আকৃতির মস্ত একটি চৌবাচ্চা নজরে পড়তে বাধ্য। আদতে এটি একটি ভ্যাট। ভ্যাট তৈরির উদ্দেশ্য, লেখা পাশের বোর্ডটিতে। লেখা, ‘‘আপনি প্লাস্টিক-মুক্ত গ্রামে প্রবেশ করছেন, আপনার সঙ্গের প্লাস্টিকের ব্যাগটি দয়া করে এখানে ফেলুন।’’
গ্রামের অন্য রাস্তা দিয়ে দিয়ে ঢোকার মুখেও আরেকটি বিশালাকৃতি ভ্যাট রয়েছে। আর গোটা এলাকায় ছোট বড়, সব মিলিয়ে সাতটি ভ্যাট। এবং রাস্তার ধারে ছোট বড় পাথর, বিদ্যুতের খুঁটি, বাড়ির দেওয়ালেও প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ে একই ধরনের সতর্কতা। সেই সতর্কতা মেনেও চলছেন গ্রামবাসী। কেমন সেই মেনে চলা, গ্রামের নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের পড়ুয়া বৈশাখি, প্রিয়া, রোহিতরা বলছে, স্কুলের সামনে একটুকরো প্লাস্টিকের ব্যাগ পড়ে থাকতে দেয় না তারা। গ্রামের চা-মিস্টির দোকানের মালিক জগন্নাথ মাজি। তিনি বলছেন, ‘‘গত দু’মাস ধরে একটিও প্লাটিকের কাপ ব্যবহার করেননি।’’ গ্রামের মাংসের দোকানে গেলেও শালপাতায় নিতে হবে মাংস। গ্রামের প্রবীণ, বাড়ির মহিলা, স্বনির্ভর দলের সদস্য, স্থানীয় ক্লাব সদস্য প্রত্যেকেই গ্রামকে প্লাস্টিক-মুক্ত করে উঠে পড়ে লেগেছেন। তাঁদের শপথ, ‘‘প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ আর নয়।’’
কেমন করে সম্ভব হল গ্রামের মধ্যে প্লাস্টিক নিয়ে এমন সচেতনতা গড়ে তোলা?
ব্লক প্রশাসন ও এলাকা সূত্রে জানা গিয়েছে, প্লাস্টিক জনজীবনে এবং পরিবেশে কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, কী করে প্লাস্টিকের ব্যবহার সচেতন ভাবে কমিয়ে ফেলা যায়, মাস দুয়েক আগে এই সচতনতা আন্দলোনের বীজ বপণ হয়েছিল গ্রামেরই একটি স্বচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে। সেটাই পরে প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যাপক আকার নেয়। ভাবনার মূলে অবশ্য খয়রাশোলের একের পর এক নির্মল গ্রাম পঞ্চায়েত গড়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সাফল্য।
ব্লক প্রশাসনের খবর, বাবুইজোড় পঞ্চায়েত খুব শীঘ্রই নির্মল গ্রাম পঞ্চায়েত ঘোষণা হতে চলেছে। এখন কাজ চলছে পুরোদমে। কদমডাঙা গ্রামে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্যানিটারি মার্টের দায়িত্বে আছে। তাঁরা বলছেন, ‘‘বাড়িতে শৌচাগার যখন হয়েছে কেন আরও একধাপ এগিয়ে ভাবব না।’’ খয়রাশোলের যুগ্ম বিডিও (যিনি নির্মল বাংলায় ওই ব্লকের নোডাল অফিসার)অভিষেক মিশ্রই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে প্লাস্টিক-মুক্ত গ্রাম গড়ে তোলা যায় কিনা আলোচনা করেছিলেন। বললেন, ‘‘প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক প্রভাব মানবদেহে, প্রাণী জগতে তো রয়েইছে, সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে সমানভাবে পড়ছে। ফলন মার খাচ্ছে, গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসায় উৎসাহী হন জেলাশাসকও। ঠিক হয়েছে এই কর্মসূচি সফল করতে যে খরচ হবে তা মিশন নির্মল বাংলার ১০০ দিনের প্রকল্প থেকে দেওয়া হবে।’’
এমন উদ্যোগে খুশি সংস্থার সদস্যরাও। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে আব্দুর রহমান জানাচ্ছেন, আমরা সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। সকলকে এই আন্দোলনের অংশীদার করতে চেয়েছিলাম। সেটা সফল’’ আব্দুর ও গ্রামের যুবক রবিউল শেখরা বলছেন, নিয়মিত প্রোজেক্টারে প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক প্রভাব তুলে ধরতে তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে কেন প্লাস্টিক ব্যবহার করব না সেটা নিয়ে রীতিমতো সচেতন কদমডাঙা। গ্রাম প্লাস্টিক-মুক্ত ঘোষণায় তাঁদের শ্রম স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি সকলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy