শাসক চলে যায়। কিন্তু শাসনের চিহ্ন রয়ে যায়। যেমন, সিউড়ি ১ ব্লকের কড়িধ্যার মহাদানী দুর্গাপুজোটি। প্রচলিত বিশ্বাস, এ পুজোর নামকরণ করেছিলেন রাজনগরের মুসলিম রাজারা। শতাব্দী প্রাচীন এ পুজোর দায়িত্বে রয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার।
শতাব্দী প্রাচীন এ পুজোটির দায়িত্ব পর্যায়ক্রমে সামলান অনাদি বন্দ্যোপাধ্যায়দের এবং প্রয়াত জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায়দের উত্তরসূরীরা। কড়িধ্যা জোড়া কালীমন্দিরের কাছে দুর্গামণ্ডপে এ বারও পুজোর প্রস্তুতি চলছে। মূর্তিতে রঙের প্রলেপ পড়েছে। বন্দ্যোপাধ্যায়দের পারিবারিক ইতিহাস বলছে, বহুকাল আগে হাওড়া জেলার আমতা থেকে বন্যার ভয়ে কড়িধ্যা এসেছিলেন তাঁদের পূর্বপুরুষ হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর হাত ধরেই এলাকার প্রাচীনতম পুজোটি তাঁদের পরিবারে এসেছে। বর্তমানে পুজো পাঁচ পুরুষ ছুঁয়ে ফেলেছে।
এ বার পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়। মীরা বলেন, ‘‘ভাই কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। বাবা-মারা যাওয়ার পরে পুজোয় দায় আমার। খুব ভাল করেই করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমার ছেলে পথ দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হয়েছিল। এখনও হুইল চেয়ারে। তবে পুজো তো হবেই।’’ দায়িত্ব যাঁরই হোক, পুজোর সময়ে পরিবারের সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। জানালেন মীরার জ্যাঠতুতো দাদা গঙ্গাধর বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরিবারের সদস্যেরা জানাচ্ছেন, পূর্বপুরুষের কাছে তাঁরা শুনেছিলেন এ পুজো আদতে ছিল এক বৃদ্ধার। তাঁর কাছ থেকেই এ পরিবার দায়িত্ব পায়। জনশ্রুতি, বহু কাল আগে রাজনগররের রাজাদের সেনা ছাউনি পড়েছিল কড়িধ্যায়। গ্রীষ্মের এক দুপুরে ক্লান্ত ও পিপাসার্ত সৈনিকেরা পানীয় জলের খোঁজে ওই বৃদ্ধার দুর্গামণ্ডপে এসেছিলেন। কথিত আছে, বৃদ্ধা তখন তাঁদের জল, বাতাসা ও ছোলা দিয়েছিলেন। সেটা রাজনগরের রাজাকে খুশি করেছিল। বৃদ্ধাকে তিনি প্রতিদানে কিছু দিতে চেয়েছিলেন। বৃদ্ধা নেননি। বৃদ্ধার সে দান থেকেই তাঁর পুজোর নামকরণ হয় মহাদানী।
শুধু জনশ্রুতি নয় ইতিহাসেও এর উল্লেখ রয়েছে। ১৭১৮-১৭৫২ সাল রাজনগরের মুসলিম শাসনের সেরা সময় বলা হয়। আসাদ-ওজ্জমান বা আসাদজামা খানের (যিনি আলিনকির ভাই ছিলেন) শাসন থেকেই অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। তার অন্যতম কারণ, ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজের পরাজয় এবং ব্রিটিশদের রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ। এত দিন পর্যন্ত রাজনগরের রাজাদের থেকে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যে নমনীয়তা দেখাতেন নবাব, ব্রিটিশ এবং তাঁদের মনোনীত নবাব মীরকাশিম সেটা দেখাননি। শুরু হয় কোন্দল। ১৭৬২ সালে সিউড়ির কাছে কড়িধ্যায় এবং হেতমপুরে রাজনগরে ব্রিটিশ ও নবাবের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে রাজনগরের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজয় হয় রাজনগরের রাজার। সেনা চাউনি পড়েছিল সে সময়েই।
এ ঘটনা ২৬৩ বছর আগে। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার দায়িত্ব পেয়েছে দেড়শো বছর আগে। মাঝের সময়টুকু কি অন্য কারও হাতে ছিল এ পুজো? এর কোনও উত্তর আপাতত নেই। এ সব নিয়ে না ভেবে এখন পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত কড়িধ্যার পরিবার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)