Advertisement
E-Paper

চাউমিন খেয়েই খরচ হয়েছিল শেষ সম্বল

পায়ের তলার সর্ষে বিহারের গাড়োয়াল থেকে গণেশকে গড়াতে গড়াতে নিয়ে এসেছিল পুরুলিয়ার ঝালদায়। কী ভাবে?

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৭ ১৯:০০
লজেন্স কই? ঝালদা থানার আইসির সঙ্গে গণেশ। নিজস্ব চিত্র

লজেন্স কই? ঝালদা থানার আইসির সঙ্গে গণেশ। নিজস্ব চিত্র

কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে পড়ায় মন বসত না আল মাহমুদের ‘পাখির মতো’ কবিতার খুদের। গণেশের গল্পটাও তেমনই। ক্লাস থ্রির পড়ুয়া। বাবা পড়াশোনায় মন দিতে বলতেন। এ দিকে ওর মন পড়ে থাকত খেলার মাঠে। অঙ্কের জটিল প্যাঁচ খোলার থেকে তরতর করে গাছের মগডালে উঠে আমটা, পেয়ারাটা পেড়ে আনাতেই ওর যত উৎসাহ। এক দিন তাই নিয়েই বাবার ধমক। আর গণেশ বইপত্র তাকে তুলে রেখে ধাঁ! কোথায়? জানা নেই।

জুলাইয়ের গোড়ায় বাবার ধমক খেয়ে বাড়ি ছেড়েছিল বছর দশেকের গণেশ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঝালদা থানায় যখন তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলেন গণেশের বাবা মনোহরিকুমার পাসোয়ান, তখন দেখা গেল অন্য ছবি। আসলে, মাঝে কেটে গিয়েছে প্রায় সতেরো দিন। গণেশের অভিমান গলে জল। অন্য দিকে তার বাবারও দুঃশ্চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ঘুচে যাওয়ার জোগাড়। ঝালদা থানার এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘দেখা হতেই বাবা-ছেলে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না!’’

পায়ের তলার সর্ষে বিহারের গাড়োয়াল থেকে গণেশকে গড়াতে গড়াতে নিয়ে এসেছিল পুরুলিয়ার ঝালদায়। কী ভাবে?

সিন্দ্রামপুর নামের একটা গ্রামে গণেশদের বাড়ি। কাছের স্টেশন প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরে। ঝালদা থানার পুলিশ কর্মীদের সে জানিয়েছে, সেই দুপুরে বাড়ি ছেড়ে সোজা স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছিল সে। কিছু দূর গিয়ে এক সাইকেলআরোহীকে বলে কয়ে তার সাইকেলের পিছনে চেপে কিছুটা পথ যায়। তারপর আরও একজনের সাইকেল। স্টেশনে পৌঁছে? গণেশের জবাব, ‘‘পতা নহি থি। ট্রেন মে চড় গয়া।’’

পকেটে ছিল ছিল খুচরো ক’টা টাকা। সন্ধ্যেয় খিদে পাওয়ায় চাউমিন কিনে খেতেই সেই সম্বলটুকুও শেষ। তার পরে চেয়েচিন্তে খাওয়া আর ট্রেনে ট্রেনে পাড়ি। এ ভাবেই সোমবার ঝালদা স্টেশনে এসে পৌঁছয় গণেশ। ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে জজলং-এর দিকে যাচ্ছিল সে। গ্রামের কাছে ঝালদা-বোগুনকোদর রাস্তায় হাত দেখিয়ে একটি অটো থামিয়েছিল। সেই অটোর চালক শীতল নাথ তাকে উদ্ধার করে পুলিশের কাছে পাঠান। অটোয় নিয়ে যাওয়ার সময়ে কথা বলতে বলতে গণেশের উপরে মায়া পড়ে যায় শীতলের। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘ভাগ্যিস অটোয় তুলে নিয়েছিলাম। না হলে এ ভাবেই হয়তো পথে পথে ঘুরে বেড়াত ছেলেটা।’’

তবে গণেশের বাড়ি খুঁজে বের করাটা খুব একটা সহজ হয়নি। ঝলদা থানার পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়ির ঠিকানা জানতে চাওয়ায় সে শুধু সংগ্রামপুর বলছিল। আর বলেছিল, সেটা নাকি কোনি বলে একটা জায়গার কাছে। পড়শি রাজ্যগুলিতে খোঁজ করে তেমন কোনও জায়গার খোঁজ মেলেনি। অবশেষে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা যায়, সিন্দ্রামপুর বলে একটা জায়গা রয়েছে বিহারের গাড়োয়াল জেলার বাঁসি থানা এলাকায়। আর তার কাছেই রয়েছে কোনা। গাড়োয়াল জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঝালদা থানার পুলিশ। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয় গণেশের ছবি। তার পরেই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের উপায় হয়। ঝালদা থানার আইসি ত্রিগুণা রায় জানান, থানায় যখন ফোনে গণেশের বাবাকে ধরা হল, হাতে ফোন পেয়ে আর ছাড়তেই চাইছিল না গণেশ।

থানা চত্বরে ছুটে বেড়ানো, পাঁচিলে চড়া, পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে দুপুরে রাতে খাওয়াদাওয়া — সব মিলিয়ে এই ক’টা দিন ঝালদা থানায় খোশমেজাজেই ছিল খুদেটি। ক’দিনেই পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছে। বাবার সঙ্গে থানা ছেড়ে যাবার আগে খোদ আইসির কানে ফিসফিস করে জানতে চেয়েছে, প্রথম দিনেই যে লজেন্স দেওয়া হয়েছিল সেগুলো আর আছে না কি? থানার এক মহিলা পুলিশ কর্মী সেই আবদারও পূরণ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ, শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র কাঞ্চন, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভোম্বল সর্দার— সবাই বাড়ি পালানো বাংলার ছেলে। তাদের সেই সবুজ দেশ দেখে মঙ্গলবার রাতে হাতিয়া-পটনা ট্রেনে বাবার সঙ্গে উঠেছে গণেশ।

Student Police Boy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy