Advertisement
E-Paper

পুরুলিয়ার অন্তরেই রয়েছে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের সংস্কৃতি

লোকসংস্কৃতি, না ‘লোকযান’। যেখানে সংস্কৃতির অর্থ শুধু নাচ, গান, আনন্দ যাপন নয়, যেখানে লোকসংস্কৃতিই হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের জীবনচর্চার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই সংস্কৃতি মানব অন্তরে জন্ম দেয় কৃতজ্ঞতাবোধের। লক্ষ্মী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে। গরু পরিবারের সদস্য। বাদ যায় না পরিবারের জড় বস্তুরাও। লিখছেন তপন পাত্র লোকসংস্কৃতি, না ‘লোকযান’। যেখানে সংস্কৃতির অর্থ শুধু নাচ, গান, আনন্দ যাপন নয়, যেখানে লোকসংস্কৃতিই হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের জীবনচর্চার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই সংস্কৃতি মানব অন্তরে জন্ম দেয় কৃতজ্ঞতাবোধের। লক্ষ্মী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে। গরু পরিবারের সদস্য। বাদ যায় না পরিবারের জড় বস্তুরাও। লিখছেন তপন পাত্র

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৪
বাঁধনা পরব উপলক্ষে সাজানো হচ্ছে বাড়ির উঠোন। ছবি: সুজিত মাহাতো

বাঁধনা পরব উপলক্ষে সাজানো হচ্ছে বাড়ির উঠোন। ছবি: সুজিত মাহাতো

সংস্কৃতি শব্দের অর্থ কী, তার ব্যাপ্তি কতটা? সে কথা নিশ্চিত করে বুঝিয়ে দেওয়ার মতো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই কোনও। সাধারণ ধারণায় সংস্কৃতি মানে নাচ-গান, নাটক, আঁকা, লেখালেখি ইত্যাদি। কিন্তু এ সব বাহ্য বা অপ্রধান। সংস্কৃতি আসলে সুরুচিপূর্ণ এক ধারাবাহিক উৎকর্ষতার চর্চা। সেই চর্চা মানুষের জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রকেই ছুঁয়ে থাকতে পারে। আর লোকসংস্কৃতি হল একেবারে লোক সাধারণের সংস্কৃতি। তবে আমার বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে ‘লোকযান’ শব্দটির ব্যবহার সঙ্গত। কারণ, ‘লোকযান’ হল, জীবনচর্চার এক দিক। প্রথাগত শিক্ষা বহির্ভূত। জনসাধারণের। যুগান্তরের। এ হল এক প্রকার বিশ্বাসের ধারা। সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের, নানা মাঙ্গলিক ক্রিয়ায়, আচার-অনুষ্ঠানে, গানে-গল্পে, প্রবাদ-প্রবচনে— সবেতেই লোকসংস্কৃতি বা লোকযানের ছোঁয়া রয়েছে।

এখনও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমানাবর্তী অঞ্চল বলতে পুরুলিয়া জেলা, ঝাড়গ্রাম জেলা, দক্ষিণ বাঁকুড়া এবং বাংলা ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের পূর্ব অংশকে বোঝায়। এই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি বলতে অনেকেই একবাক্যে বলবেন, কয়েকটি লোকগান এবং লোক উৎসবের কথা। কিন্তু এই নাচ-গান-বিনোদনের ঊর্ধ্বে সারা বছর ধরে যে লোকাচার, পুজাপাঠ এখানকার মানুষ পালন করেন, তার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের কৃতজ্ঞতাবোধের সংস্কৃতি।

এই পশ্চিম সীমান্তবঙ্গের লোকাচার, লোকসংস্কৃতি আসলে কৃতজ্ঞতা জানানোর সংস্কৃতি। শুধু মানুষ নয়, অন্য প্রাণী নয়, অচেতন সামগ্রীর উপরেও চেতন-ধর্ম, দেবধর্ম আরোপ করে তাদের পূজা, তাদের বন্দনা করা। মানবতা মানবের শ্রেষ্ঠ গুণ। কৃতজ্ঞতা মানবতার এক বিশেষ অঙ্গ। কৃতজ্ঞতাবোধ প্রমাণ করে ব্যক্তি সংস্কৃতিশীল কি না। কৃতজ্ঞতা প্রকৃত পক্ষেই সংস্কৃতির অপর নাম। অপর একটি দিকচিহ্ন।

বঙ্গের এই অঞ্চলের গানবাজনার সংস্কৃতির দিক থেকেই শুরু করা যাক। এখানে যে কোনও গান, নাচ পরিবেশনের প্রথমে ‘আখড়া’ বন্দনা করা হয়। এর মাধ্যমে যে মাটিতে দাঁড়িয়ে বা বসে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কৃতজ্ঞতা জানানো হয় সেই মাটির প্রতি। তাই গান শোনা যায়, ‘আখড়া বন্দনা করি/ গাঁয়ের গরাম হরি/ তার পরে বন্দনা ব্রজনারী’। শুধু মাটি নয়, গ্রাম দেবতাকে এবং ব্রজনারী বলতে ব্রজের নারী নয়, স্থানীয় মহিলাদের স্তুতি করা হচ্ছে, কারণ তাঁদের সাহায্য ছাড়া সকল শিল্পই অসম্ভব।

আমরা দেখি টুসু পূজা, ভাদু পূজায় মূল উদ্যোক্তা কুমারি মেয়েরা। এই উৎসবে শ্রদ্ধা জানানো হয় এই দুই লোকদেবীর প্রতি। এই পূজার উদ্দেশ্য, উৎপাদিকা শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন। সম্মান প্রদর্শন। একই ধরনের ভাবনার প্রকাশ ‘করম’-এ, ‘জাওয়া’-য়। আবার ১৩ জৈষ্ঠ রোহিনীর দিন ‘বীজপুণ্যা’। কৃষক তাঁর খেতের এক কোণে মাটি তৈরি করে লৌকিক পদ্ধতিতে পূজা-অর্চনা সেরে ধানবীজ ছড়িয়ে দেন। আশ্বিনের সংক্রান্তিতে যখন সারা মাঠে ফসল, তখন হয় লক্ষ্মীর সাধভক্ষণ। কৃষক শুভ্র-সুচি বস্ত্র পরে আতপচাল, দুধ, মিষ্টি, ফল, আখ ইত্যাদি মিশিয়ে সাধ-অন্ন তৈরি করে খেতে নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়ে আসেন। মানপাতায় সাজিয়ে দেওয়া হয় অন্ন, পাশে থাকে ওলের টুকরো। উচ্চারিত হয় লৌকিক মন্ত্র— ‘ওল গোল গোল, মানের পাত, ভজ মা লক্ষ্মী দুদুভাত’। এই খাবারগুলির সঙ্গে ধানগাছের স্বাস্থ্যবতী হওয়ার কোনও বিজ্ঞানসম্মত কারণ নেই, কিন্তু যা আছে তা হল, মেয়ে বা গর্ভসম্ভাবনাময়ী মায়ের প্রতি ভালবাসা। আবার যে দিন কৃষকের খেতের সব ধান এসে যাচ্ছে খামারে, সে দিন শেষ আঁটিটিকে ফুলে-পল্লবে সাজিয়ে ধূপধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে আসা হয় খামারে। পরদিন খামারের কপাট থাকে বন্ধ। সে দিন লক্ষ্মীর বিশ্রামের দিন।

কার্তিক মাসে কালীপূজার পরদিন গো-বন্দনা করেন এখানকার চাষিরা। এটি ‘বাঁধনা পরব’ নামে পরিচিত। এই পরবে আদর যত্ন করে গরু-গাভীদের স্নান করানো হয়। সর্ষের তেল দিয়ে মালিশ করে দেওয়া হয় শিং। গরুর সারা গায়ে আঁকা হয় নানা রঙের ছবি। খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও থাকে। সন্ধ্যায় থালা সাজিয়ে, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে গরুদের পূজা করা হয়। পূজা করা হয় কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিরও। লাঙল, মই, জোয়াল, ঘরের খুঁটি, ঢেঁকি, দরজা, জানলা—কেউ পূজা থেকে বঞ্চিত হয় না এ দিন। এগুলি অচেতন বস্তু হলেও বারোমাস আমাদের সেবায় নিবেদিত। তাই সেগুলির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে এই উৎসব।

বাঁধনা পরবের পর দিন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। তার পর দিন যমদ্বিতীয়া। সে দিন গো-বন্দনার রীতিতেই মোষের বন্দনা করা হয়। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় গবাদিপশুর উপকারিতা কম নয়। তাই তা স্বীকার করে তাদেরও পূজো।

অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির রাতে পূজা করা হয় কৃষকের খামারের টাঁড়, মুগুর, ঝু়ড়ি, ঝাঁটা, কুলা, ডালা ইত্যাদি দ্রব্যাদির। পরদিন সেগুলি ছোঁয়া নিষেধ, এমনকী, সেগুলি যে খামারে রাখা হয় সেখানে ঢোকাই নিষেধ। সে দিন ওই সব সাংসারিক সরঞ্জামের বিশ্রামের দিন।

পৌষ সংক্রান্তির দিন হয় পিঠের উৎসব। সংক্রান্তির আগের দিন ‘বাউড়ি’। ‘বাউড়ি’ মানে পিঠে তৈরির হাঁড়িতে খড়ের দড়ির পৈতে পরানো। এ বিশেষ সম্মান প্রদর্শন ছাড়া আর কী! মাঘ মাসে হয় পান্তাভাত উৎসব। সে দিন রান্নাবাটির বিশ্রামের দিন। ষষ্ঠীপূজার দিন উনুন পূজা, শিল-নড়া, বঁটি— এক কথায় যাবতীয় রান্না-সামগ্রীর পূজা এবং বিশ্রামদানের প্রয়াস। এটাই কৃতজ্ঞতা।

তবে সময় যত এগোচ্ছে সব বিভাগে লোকসংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন চোখে পড়ছে। খেয়াল রাখতে হবে, আধুনিকতার মাঝে আন্তরিকতার এমন ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়!

লেখক মানভূমের লোকসংস্কৃতি গবেষক

Festival Culture
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy