Advertisement
E-Paper

খেলনা গড়েই সুখী চম্পারা

পরের সন্তানের মুখের হাসি এত দিন ওঁদের সন্তানকে কাঁদিয়েছে। এ বার ওঁরা অন্যের সন্তানের মুখে হাসি ফুটিয়েই নিজের সন্তানের সেই কান্না ঘুচিয়ে দিয়েছেন। শুধু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোই নয়, আত্মবিশ্বাসও অর্জন করেছেন রিঙ্কু পাল, চম্পা মণ্ডল, কল্যাণী ভাণ্ডারিরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০১:৪৪
‘সফট্ টয়’ বানাতে ব্যস্ত কোটাসুরের মহিলারা। তৈরি হওয়া খেলনায় মজেছে তাঁদের খুদেরাও। —নিজস্ব চিত্র

‘সফট্ টয়’ বানাতে ব্যস্ত কোটাসুরের মহিলারা। তৈরি হওয়া খেলনায় মজেছে তাঁদের খুদেরাও। —নিজস্ব চিত্র

পরের সন্তানের মুখের হাসি এত দিন ওঁদের সন্তানকে কাঁদিয়েছে। এ বার ওঁরা অন্যের সন্তানের মুখে হাসি ফুটিয়েই নিজের সন্তানের সেই কান্না ঘুচিয়ে দিয়েছেন। শুধু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোই নয়, আত্মবিশ্বাসও অর্জন করেছেন রিঙ্কু পাল, চম্পা মণ্ডল, কল্যাণী ভাণ্ডারিরা।

ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরের বাসিন্দা চম্পা মণ্ডলেরা অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের বধূ। বিভিন্ন সময়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মেলা কিংবা বাজারে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাঁদের। অন্যের সন্তানের হাতে খেলনা দেখে, তা নেওয়ার জন্য কান্না জুড়ে দিয়েছে ছেলেমেয়েরা। কিন্তু, তা কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না রিঙ্কুদের। তাই মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফিরে অক্ষমতার জ্বালায় মনমরা হয়ে কাটাতে হয়েছে। এখন আর সেই পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় না চম্পাদের। বরং তাঁরাই আজ অন্যের সন্তানের মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজের ছেলেমেয়ে হাতে তুলে দিচ্ছেন নানা রংবেরঙের খেলনা।

কী করে হল এই পট-পরিবর্তন?

ওই সব বধূরাই জানিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের কান্না ঘোচাতে প্রথম দিকে তাঁরা রংবেরঙের পুরনো কাপড় সেলাই করে নানা ধরনের পুতুল গড়ে দিতেন। কল্যাণীদেবীদের হাতে গড়া সেই সব পুতুল দেখে পড়শিরাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্য পুরনো কাপড় এবং যৎসামান্য কিছু পারিশ্রমিক দিয়ে তা করিয়ে নেওয়ার জন্য হাজির হতে থাকেন। তখনই পেশাদারি ভাবে পুতুল গড়ার ভাবনাটা মাথায় আসে ওই সব বধূদের। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। বছর তিনেক আগে তাঁদের মতো দশ জন বধূ মিলে তৈরি করেন ‘জগদ্বন্ধু স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী’।

গোষ্ঠী তো হল, কিন্তু কী করে কাঁচামাল কেনার পুঁজি জোগাড় করবেন, কী করেই বা নিত্য নুতন খেলনা তৈরি করা শিখবেন— তা ভেবেই কিছুটা মুষড়ে পড়েন তাঁরা। সেই সময়েই মুশকিল আসান হয়ে দেখা দেয় ব্লক প্রশাসনে আয়োজিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা। ২০ দিনের সেই কর্মশালায় ওই গোষ্ঠীর ৬ জন সদস্যা যোগ দেন। সেখানেই ‘সফট্ টয়’ তৈরির প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষাভাতা বাবদ হাতে পান মোট ৭,২০০ টাকা। তা দিয়েই যাত্রা শুরু হয়।

এখন মেলায় মেলায় স্টল দেন গোষ্ঠীর সদস্যেরা। সেখানে তাঁদের তৈরি খেলনা কিনে হাসি ফোটে মেলায় আসা খুদেদের। কল্যাণী ভাণ্ডারি, বাবলি পালরা বলছেন, ‘‘এক সময়ে মেলা কিংবা বাজারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। অন্য বাচ্চার হাতে খেলনা দেখে তা নেওয়ার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েরা কান্না জুড়ে দিত। আমাদের তা কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্যও ছিল না। মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে কোনও রকমে তাদের বাড়ি ফিরিয়ে আনতাম। কী যে কষ্ট হতো, তা আমরাই জানি।’’ গোষ্ঠীর সহ-দলনেত্রী পুতুল সরকার, চম্পা মণ্ডলরা জানান, খেলনা বিক্রির উপার্জন দিয়ে এখন নিজেদের তৈরি খেলনা তো বটেই, অন্য খেলনাও তাঁরা ছেলেমেয়েদের কিনে দিতে পারেন থেকে।

শুধু ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটানোই নয়, খেলনা গড়েই আত্মবিশ্বাসও অর্জন করেছেন গোষ্ঠীর সদস্যেরা। ৬০ বছরের দয়াময়ী ভান্ডারি, ৫৫ বছরের আল্পনা মণ্ডলদের কথায়, ‘‘বয়সজনীত কারণে আমরা তো বাতিলের দলেই পড়ে গিয়েছিলাম। মা-ঠাকুমার কাছে পুরনো কাপড় সেলাই করে পুতুল তৈরি করা শিখেছিলাম। নাতি-নাতনিদের কান্না ঘোচাতে বৌমা-নাতবৌদের সে ভাবেই পুতুল তৈরির পরামর্শ দিতে গিয়ে আমরাও গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। এখন আমরাও পুতুল গড়ে নিজেদের খরচটুকু নিজেরাই জোগাড় করে নিতে পারছি।’’ গোষ্ঠীর দলনেত্রী চম্পা চক্রবর্তী জানান, এক জন সদস্যা এক দিনে একটি বড় কিংবা দু’টি ছোট খেলনা তৈরি করতে পারেন। একটি বড় এবং ছোট খেলনার জন্য কাঁচামাল (মখমলের কাপড়, সিনথেটিক তুলো, উল, সুতো) লাগে যথাক্রমে ২৫০ এবং ৫০ টাকার। বিক্রি করে দাম মেলে যথাক্রমে ৫০০ এবং ১০০ টাকা। তাঁর দাবি, ‘‘উপযুক্ত পুঁজি এবং বিপণনের নিশ্চয়তা থাকলে খেলনা গড়েই এক জন সদস্যা বাড়ির কাজ সামলেও সহজেই মাসে ৩-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।’’

ওই সম্ভাবনার কথা মেনে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিডিও (ময়ূরেশ্বর ২) সৈয়দ মাসুদুর রহমান জানান, ওই গোষ্ঠীর খেলনা বিক্রির জন্য বিভিন্ন মেলায় স্টলের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও বিপণনের বিকল্প উপায়ও ভাবা হচ্ছে। গোষ্ঠীর সদস্যেরা আবেদন করলেই ভর্তুকিযুক্ত ঋণেরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

Self-help group Children toys
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy