Advertisement
০৪ মে ২০২৪

স্টেশনে নামতেই স্লোগান উঠল, ‘সোনার মেয়ে সোমা’

রাজনৈতিক নেতারা ছাড়া কাউকে নিয়ে এতটা মাতামাতি অনেকদিন দেখেনি পুরুলিয়া। পুরুলিয়া স্টেশন থেকে মেয়েটাকে নিয়ে সেই যে জনউন্মাদনা শুরু হয়েছিল, শহর ঘুরে তা শেষ হল মফস্সল থানার মাঙ্গুরিয়া গ্রামে গিয়ে। চারদিকে শুধু একটাই স্লোগান— পুরুলিয়ার সোনার মেয়ে সোমা কর্মকার স্বাগতম।

জনতার সংবর্ধনা। পিছনে হুডখোলা জিপে সোমা।

জনতার সংবর্ধনা। পিছনে হুডখোলা জিপে সোমা।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৫ ০০:৫৭
Share: Save:

রাজনৈতিক নেতারা ছাড়া কাউকে নিয়ে এতটা মাতামাতি অনেকদিন দেখেনি পুরুলিয়া। পুরুলিয়া স্টেশন থেকে মেয়েটাকে নিয়ে সেই যে জনউন্মাদনা শুরু হয়েছিল, শহর ঘুরে তা শেষ হল মফস্সল থানার মাঙ্গুরিয়া গ্রামে গিয়ে। চারদিকে শুধু একটাই স্লোগান— পুরুলিয়ার সোনার মেয়ে সোমা কর্মকার স্বাগতম।

রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে দেখেই ওই স্লোগানে রবিবার গমগম করে উঠল পুরুলিয়া স্টেশন। ট্রেন তখনও থামেনি। উৎসাহী কেউ কেউ চলন্ত ট্রেনেই উঠে পড়লেন, কোথায় সোনার মেয়ে? পরনে নেভি ব্লু জাতীয় দলের ব্লেজার, কালো জিনস, মুখে লাজুক হাসি নিয়ে এগিয়ে এলেন সোমা। ততক্ষণে উৎসাহী মানুষের দখলে চলে গিয়েছে প্ল্যাটফর্ম, ওভার ব্রিজের সিঁড়ি। কারও হাতে ফুল, কারও মালা, কেউ তাঁর দিকে ফুল ছুঁড়ছেন। দুর্গাপুর থেকেই মেয়ের সঙ্গী ছিলেন মা ধেলুদেবী। তাঁর কাছ থেকে প্রায় ছিনিয়েই জনতার ভিড় সোমাকে তুলল হুডখোলা জিপে।

মানুষের ভিড় কাটিয়ে গা়ড়ি রওনা দিল সংবর্ধনা মঞ্চের দিকে। সম্প্রতি চিন থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্কুল গেমস’-এ লং জাম্পে সোনার পদক জিতে ফিরেছে সোমা। দুর্গাপুরে সেল অ্যাকাডেমিতেই গত কয়েকটা বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। চিন থেকে ফিরে সেখানে ক’টা দিন কাটিয়েই সোমা এ দিন ফিরলেন নিজের গ্রামে মাঙ্গুরিয়ায়। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার আগে সোনার মেয়ের ঘরে ফেরাকে স্মরণীয় করে রাখতে পুরুলিয়া শহরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করেছিল পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ।

কৃতী মেয়েকে বরণ করছেন মা।

এক দিকে মাইকে সোনার মেয়ের নামে জয়ধ্বনি, অন্যদিকে রঙ-বেরঙের আবিরে ভরা বর্ষাতেও তখন বসন্তের আবহ। সোমার গাড়ির সঙ্গে জনতার ভিড় এগিয়ে চলল রাধাকৃষ্ণ মোড়, নীলকুঠিডাঙা, পুরাতন পুলিশ লাইন, মানভূম ক্রীড়া সংস্থার মাঠ, হাটের মোড়, চাইবাসা রোড হয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। রবিবারের ছুটির আলসেমি কাটিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে তখন মানুষের ভিড়। নামতে হয়েছিল পুলিশকেও। তাঁকে দেখে দূর থেকে হাত নেড়েছেন অনেকেই। প্রতি নমস্কারে একই ভাবেই লাজুক হাসিতে শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা ফিরিয়ে দিয়েছেন সোমা। সংবর্ধনা মঞ্চে অপেক্ষা করছিলেন পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো, বিধায়ক কে পি সিংহ দেও, সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতো-সহ অনেকেই। আর ভ্যাপসা গরম ও রোদ মাথায় মঞ্চের সামনে অপেক্ষামান জনতা। গাড়ি মঞ্চের কাছে পৌঁছতেই ভিড় ফের শ্লোগান তুলল সোনার মেয়ে সোমা স্বাগতম।

সোমাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে শান্তিরামবাবু বলেই বসলেন, ‘‘সোমা তো আমার ব্লকেরই মেয়ে। সেই অর্থে এই সাফল্য জেলার পাশাপাশি আমার ব্লকেরও।’’ মন্ত্রী মনে করিয়ে দিলেন, সোমা যে ভাবে অভাবের মধ্যেও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আসর থেকে সোনা এনেছে তাতে প্রমাণিত হল, এই জেলার পিছিয়ে পড়া এলাকা থেকেও অন্যেরা একইরকম সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারেন। তবে তাঁদেরও সোমার মতো জেদ ও অধ্যবসায় থাকতে হবে। তিনি সোমার হাতে দফতরের পক্ষ থেকে একটি স্মারক, জুতো, ট্রাকস্যুট ও ১১ হাজার টাকা তুলে দেন।

পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের চিফ এগ্‌জিকিউটিভ অফিসার শ্যামাশিস রায় বলেন, ‘‘কে বলেছে পুরুলিয়া পিছিয়ে পড়া! সোমার মতো মেয়েরাই পুরুলিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’’ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) প্রবালকান্তি মাইতি। সকলেই সোমাকে আগামী দিনের জন্য শুভেচ্ছা জানান। তবে মঞ্চে সোমার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য খানিক বিশৃঙ্খলাও চোখে পড়ে। মঞ্চের সামনে উপস্থিত অনেকেই চেয়েছিলেন সোমার মুখ থেকে কিছু শুনতে। কিন্তু মঞ্চের উপর ভিড় ও অন্য বক্তাদের মাঝে সোমারই কিছু বলার সুযোগ হয়নি।

বাড়ি ফেরার পথে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আর এক উঠতি অ্যাথলেট বোন চন্দনা ও শৈশবের প্রশিক্ষক বাসুদেব মাহাতো। গ্রামের মাথাতেই সোমার জন্য অপেক্ষায় ছিল আরও একটা বড় ভিড়। ঘরের মেয়েকে বিজয়ীর হাসি নিয়ে আসতে দেখে চোখের জল বাঁধ মানছিল না অনেকের। সোমার শৈশবের সঙ্গী বেলা মাহাতো বলছিলেন, ‘‘আমি, সোমা ও চন্দনা সৈনিক স্কুলের মাঠে দৌড়তাম। তখনই দেখেছিলাম ওর জেদ রয়েছে। তবে সে সেল অ্যাকাডেমিতে গিয়ে নিজেকে অনেক পরিণত করেছে।’’

প্রদীপ জ্বালিয়ে মেয়েকে বরণ করে নেন বাড়ির লোকজন ও পড়শিরা। বাড়িতে তাঁর জন্য কাকিমা রান্না করে রেখেছিলেন ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, কুঁদরি ভাজা ও মুরগির মাংস। মেয়েকে দেখার তর না সওয়ায় মা ধেলুদেবী নিজেই দুর্গাপুরে নিয়েছিলেন তাঁকে আনতে। মায়ের স্মৃতিতেও ভেসে উঠছিল ফেলে আসা দিন। তাঁর কথায়, ‘‘তখন কত কষ্ট করেছে। কী আর ওকে দিতে পেরেছি। আজ বড় আনন্দ হচ্ছে।’’ বোন অবশ্য দিদির কাছে চিনের গল্প শুনবে বলে ঠিক করে রেখেছে।’’

২০০৯ সালে রাজ্য প্রাথমিক ক্রীড়ায় মালদহে লংজাম্পে সোনা জেতার স্বাদ পেয়েছিলেন সোমা। এ বার চিনে। তবে নিজের মাঠকে ভুলতে পারেননি তিনি। বিকেলে সব ফেলে সেই মাঠেই হাজির হলেন তিনি। বললেন, ‘‘পুরুলিয়ার অনেক মেয়ের মধ্যেই সম্ভাবনা রয়েছে। দরকার শুধু প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ।’’ বুধবার পর্যন্ত বাড়িতেই থাকছেন তিনি। তাঁর চোখ এখন এশিয়াড।

ছবি: সুজিত মাহাতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE