হারিয়ে যেতে বসেছে এই গ্রামীণ ছবি। মাড়গ্রামের কার্তিকচুংড়ি গ্রামে ঢেঁকিতে চাল কুটছেন মহিলারা। —ফাইল চিত্র
ঢেঁকিশালে সেই ঢেঁকি নেই। হারিয়ে গিয়েছে চাল কোটার সেই ধুপধাপ শব্দও। কিন্তু ময়ূরেশ্বরের পারচন্দ্রহাটের ৮৭ বছরের বৈদ্যনাথ মণ্ডল, লাভপুরের দাঁড়কার ৭০ বছরের কাশীনাথ কোঁড়ারা আজও ভুলতে পারেননি ঢেঁকিছাঁটা চালের কথা। বিশেষ করে নবান্নের মরসুম এলে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন তাঁরা। আজও যেন তাঁদের মুখে লেগে রয়েছে ঢেঁকিছাঁটা চালের গুড়ির স্বাদ।
স্মৃতি হাতড়ে প্রবীণেরা জানিয়েছেন, বছর ১৫-২০ আগেও গ্রামে গ্রামে এত ধান ভাঙার কল ছিল না। প্রতিটি গ্রামেই ৩-৪ জন অবস্থাপন্নের বাড়ির ঢেঁকিশালে ঢেঁকি থাকত। প্রথম দিকে ভাতের চালও ওই সব ঢেঁকি থেকেই তৈরি হতো। ৩-৪টি পরিবারের মহিলারা পারস্পরিক সহযোগিতায় ধান থেকে সেই চাল তৈরি করতেন। তার পর ক্রমে ভাতের চাল তৈরির প্রবণতা কমে গেল। কিন্তু বছর দশেক আগেও নবান্নের চালের জন্য ঢেঁকির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। আজও সেই সব দিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে পারচন্দ্রহাটের ৭৫ বছরের মোহনচন্দ্র মণ্ডল, ৭০ বছরের বিজয়কৃষ্ণ মণ্ডলদের। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমাদের বাড়িতেও ঢেঁকি ছিল। ভোর থেকে পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে চালের গুঁড়ি করতে আসতেন। ঢেঁকির ছন্দবদ্ধ ধুপধাপ শব্দে সারা পাড়া জেগে উঠত। আজও ঢেঁকি ছাঁটা চালগুড়ির নবান্নের স্বাদ যেন মুখে লেগে রয়েছে। আর এখনকার মেশিনে পেষাই করা গুড়ি কেমন যেন আঁঠা-আঁঠা, পোড়া পোড়া লাগে।’’
ঢেঁকিতে চালগুঁড়ি তৈরির কথা আজও ভোলেননি ওই গ্রামেরই ৭৫ বছরের ঊষারানি মণ্ডল, ৭৪ বছরের উল্লাসী মণ্ডল, লাভপুরের শাহআলমপুরের ৬৫ বছরের বাসন্তী মণ্ডলরা। তাঁরা বলেন, ‘‘নবান্নের মরসুম এলেই ভোরে আমরা স্নান সেরে ধোপদুরস্ত পোশাক পড়ে মা-শাশুড়িদের সঙ্গে চালের গুড়ি তৈরি করতে ঢেঁকিশালে ঢুকতাম। বেরোতে দুপুর গড়িয়ে যেত।’’
শুধু নবান্নের জন্যই নয়, মিষ্টি তৈরির জন্যও ঢেঁকিছাটা চলের গুঁড়ির কদর দীর্ঘ দিনের। একসময় নবান্ন উপলক্ষে অধিকাংশ বাড়িতেই নিজে হাতে ছানাবড়া, জিলিপি, বোঁদে জাতীয় মিষ্টি তৈরির চল ছিল। ওই সব মিষ্টি তৈরিতে ঢেঁকিছাঁটা চালের গুঁড়ি আলাদা একটা মাত্রা এনে দিত বলে প্রবীণদের দাবি। নবান্ন উপলক্ষে আজও নিজে হাতে বাড়িতে মিষ্টি তৈরির চল রয়েছে লাভপুরের সুন্দরা গ্রামের শান্তিরাম মণ্ডল, ময়ূরেশ্বরের কুসুমীর শিশির মণ্ডলদের পরিবারে। তাঁদের কথায়, ‘‘ঢেঁকিছাঁটা চালের গুঁড়িতে তৈরি জিলিপি যেমন মুচমুচে হয়, ছানাবড়াও তেমন নরম হয়। আর এখনকার মেশিনের চালগুঁড়ি দিয়ে মিষ্টি করা মানে তো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy