Advertisement
E-Paper

যেন আমাদেরই এক জন, গায়ত্রীর সম্মানে খুশি বীরভূমের গ্রাম

নরওয়ের শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রালয়ের পক্ষ থেকে বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় আর্টস, হিউম্যানিটিজ ও সোশাল সায়েন্সের গবেষণার জন্য প্রতি বছর একজন স্কলারকে বাছে।

রাজনগরের গ্রামের এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন গায়ত্রী।

রাজনগরের গ্রামের এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন গায়ত্রী। (ফাইল চিত্র) সংগৃহীত।

দয়াল সেনগুপ্ত 

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৯
Share
Save

রাজনগরের গাং-মুড়ি গ্রামের ঘরটিতে ইটের দেওয়াল, টিনের ছাউনি। দেখে বোঝার উপায় নেই এই ঘরে বহু দিন কাটিয়ে গিয়েছেন বিশ্ববরেণ্য শিক্ষাবিদ, তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। তিনি থেকেছেন শুধুমাত্র এলাকার পিছিয়ে পড়া শিশুদের শিক্ষার জন্য। কলা বিভাগে শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘নোবেল’ পুরস্কারের সঙ্গে তুলনীয়, নরওয়ের হলবার্গ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ার পর ‘দিদি’ গায়ত্রীর জন্য খুশি রাঢ়বঙ্গের সেই প্রান্তিক এলাকার মানুষজন।

নরওয়ের শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রালয়ের পক্ষ থেকে বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় আর্টস, হিউম্যানিটিজ ও সোশাল সায়েন্সের গবেষণার জন্য প্রতি বছর একজন স্কলারকে বাছে। এ বার বিশ্ব জুড়ে অত্যন্ত সম্মাননীয় ওই পুরস্কারটি পাচ্ছেন আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অধ্যাপিকা গায়ত্রী। পুরস্কার সম্পর্কে তেমন স্বচ্ছ ধারণা নেই রাজনগরের ওই গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকেরই। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে দু’দশকের বেশি কাটানো ‘দিদি’-কে মনে রেখেছেন সকলে। তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তিতে খুশি বীরভূমের গ্রামও।

বীরভূমের বাসিন্দা ঢেকারো সম্প্রদায়ের মানুষজন মূলত লোহা গলানোর কাজে যুক্ত ছিলেন। পরে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সঙ্কটের জন্য ওই পরিবারের বহু সদস্যই অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিলেন। বঞ্চিত হচ্ছিল ওই পরিবারগুলির শিশুদের ভবিষ্যৎ। সেই সমস্যা মেটাতেই আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বীরভূমের ওই পরিবারগুলির শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন গায়ত্রী। সালটা ২০০১।

রাজনগরের গাংমড়ি গ্রামে এক কাঠা জায়গায় একটি বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন গায়ত্রী। তবে শুধু ওই গ্রাম নয়, রাজনগরের আরও তিনটি, সিউড়ি ও মহম্মদবাজারের একাধিক গ্রামের মানুষ খুব কাছ থেকে ওঁকে দেখেছেন।প্রথমে রাজনগরের সাহাবাদ ও মহম্মদবাজারের রাসপুর— এই দু’টি গ্রামে স্কুল খোলেন তিনি। পরে স্কুলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৬টি। রাজনগরের টাবাডুমড়া ও হরিপুরে স্কুল খোলা হয়। সিউড়ির লাঙুলিয়া ও মহম্মদবাজারের বৈদ্যনাথপুরেও স্কুল খোলেন গায়ত্রী। সেই স্কুলেই ঢেকারো সম্প্রদায় ও সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন গায়ত্রী। প্রতি স্কুলে শিক্ষক ও পরিদর্শক নিয়োগ হয়।

তেমনই এক পরিদর্শক ছিলেন ধনঞ্জয় লোহার। তিনি গায়ত্রীর স্কুলে শিক্ষকতা ও পরিদর্শকের কাজ করেছেন। তিনি বললেন, ‘‘মাধ্যমিক পরীক্ষার পর দিদির সঙ্গে পরিচয়। স্কুলে যা শিখেছি তার থেকে বহুগুণ শিখেছি দিদির কাছে।’’ ধনঞ্জয়, ‘‘জানতাম তিনি খুব বড় মাপের মানুষ। কিন্তু কাছে যখন থাকতেন কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। তিনি ঘরেরই একজন।’’ প্রায় একই বক্তব্য সাহাবাদ স্কুলের শিক্ষিকা কাকলি মণ্ডলের। তিনি বললেন, ‘‘দিদি খুব সাধারণ থাকতেন। সব সময় এলাকার গরিব শিশুদের কথা ভাবতেন। খুব ভাল লাগছে ওঁর পুরস্কার পাওয়ার খবর।’’

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সন্তোষ কর্মকার জানান, তাঁরে মায়ের থেকেই গাংমড়ি গ্রামে জমি কিনেছিলেন তিনি। সেখানেই থাকতেন যখন বীরভূমে আসতেন। স্থানীয়রা জানান, এক সময় প্রতি দু’মাস অন্তর আমেরিকা থেকে বীরভূমের গ্রামে আসতেন গায়ত্রী। কেমন চলছে শিশুদের পাঠ নিজে দেখতেন। শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। আর জীবনের মানোন্নয়ন কী ভাবে হবে, জৈব চাষ কী ভাবে করা যায় সে সবও শেখাতেন। কিন্তু সকলেই এক বাক্যে বলছেন, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের পুরোটাই গায়ত্রী করেছেন নিঃশব্দে। সন্তোষ বললেন, ‘‘যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে একটি বকুল গাছ লাগিয়েছিলেন। সেটাও কেনিয়ার এক মহিলার নামে উৎসর্গ করা, যিনি বহু গাছ লাগিয়েছেন।’’

রাজনগরের বিডিও থাকাকালীন খুব কাছ থেকে গায়ত্রীকে দেখেছেন শুভদীপ পালিত। এখন তিনি কর্মরত বাঁকুড়ায়। তিনি বললেন, ‘‘গান্ধীর একটি কথা আছে সিম্পল লিভিং হাই থিঙ্কিং। সেটা যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে দেখেছি তাঁকে। যখন রাজনগরে আসতেন, তখন সাধারণের সঙ্গে মিশে থাকতেন। যা এলাকায় পাওয়া যায় তাই খেতেন। সাধারণ ঘরে থাকতেন। কোনও দিন কোনও প্রয়োজনের কথা বলেননি। গাড়িও চড়তেন না।’’

আর পাঁচ জনের চেয়ে যে ‘দিদি’ আলাদা তা বুঝতে পেরেছেন স্থানীয়রাও। রাজনগরের বাসিন্দা স্বপন দাস, মমতা দাস, সেলিমা বিবিরা বলেন, ‘‘তাঁর জ্ঞানের পরিধি বা তিনি কোন উচ্চতার মানুষ সেটা বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে তিনি আমাদের সঙ্গে প্রতিবেশীর মতোই মিশতেন। খোঁজ খবর নিতেন। প্রয়োজনে সাহায্য করতেন।’’ বছর তিনেক আগে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। তবে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, গায়ত্রীর প্রচেষ্টার ফল ভোগ করছে অনেকেই। পিছিয়ে পড়া সমাজের আজ অনেকেই প্রতিষ্ঠিত, বলছেন গ্রামের বাসিন্দারই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

rajnagar

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}