জাল নথি ও ভুয়ো তথ্য দিয়ে শিক্ষকতা করায় অভিযুক্ত সঙ্গীতভবনের অধ্যাপককে ‘ক্লিন চিট’ দেওয়া নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে বিশ্বভারতীরই অন্দরে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় নিযুক্ত তদন্ত কমিটির বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অভিযোগকারীর আইনজীবী।
কলকাতা হাইকোর্টের ওই আইনজীবী ইন্দ্রদীপ পালের প্রতিক্রিয়া, “ওই নিয়োগের ঘটনায় বিশ্বভারতী নিজেও অভিযুক্ত। কোন নীতিতে ওই প্রতিষ্ঠান আভ্যন্তরীণ সদস্যদের দিয়ে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগেরই তদন্ত করাতে পারে? কমিটিতে তো এক জনও বাইরের সদস্য নেই। এ ভাবে অভিযুক্ত অধ্যাপক এবং নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ‘ক্লিন চিট’ দেওয়াটা অত্যন্ত হাস্যকর একটি ব্যাপার!” গত ১৭ জুলাই বিশ্বভারতীর ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে বোলপুর থানায় এফআইআর করেন ওই একই পদের জন্য আবেদনকারী অন্য এক প্রার্থী। অভিযোগকারী সম্প্রতি এ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলাও করেছেন। অভিযোগ ওঠার পরপরই বিশ্বভারতী ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। শনিবারই বিশ্বভারতীর মিডিয়া ইন্টারফেস কমিটির চেয়ারপার্সন অধ্যাপিকা সুবজকলি সেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তদন্ত কমিটি ওই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনও সারবত্তা দেখতে পায়নি।
বিশ্বভারতী সূত্রের খবর, সঙ্গীতভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের আমলে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ রবীন্দ্রসঙ্গীত, নৃত্য ও নাটক বিভাগে কথাকলি নৃত্যের একটি অধ্যাপক পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া েযাগ্যতা অনুযায়ী আবেদনপত্র গৃহীত হয়। ফলপ্রকাশের পরে কেরলের এক বাসিন্দাকে বিশ্বভারতী নিয়োগ করে। ওই পদের জন্য কেরলেরই আর এক বাসিন্দা এ রাধাকৃষ্ণনও বিশ্বভারতীতে আবেদন করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ, ওই পদে বর্তমানে কর্মরত অধ্যাপক বেশ কিছু ভুয়ো তথ্য দিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁর দাবি, সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক বয়স, শিক্ষাগত েযাগ্যতা-সহ একাধিক ক্ষেত্রে ভুয়ো তথ্য দিয়েছেন। বিতর্ক শুরু হতেই চাপের মুখে বিশ্বভারতী তড়িঘড়ি রবীন্দ্রভবনের অধ্যাপক উদয়নারায়ণ সিংহের নেতৃত্বে একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি অবশ্য রাধাকৃষ্ণানের অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই জানিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে। কমিটি মনে করে সঠিক পদ্ধতি মেনে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপককে বিশ্বভারতী নিযোগ করেছে। অধ্যাপকের দাখিল করা নথি-তথ্যে এবং এই নিয়োগে কোনও গলদ নেই।
বিশ্বভারতীর ওয়েবসাইটে অভিযুক্ত অধ্যাপকের জীবনপঞ্জি অনুযায়ী তিনি ১৯৮১ সালে কেরালা কলামণ্ডলম থেকে চার বছরের একটি প্রফেশনাল কোর্স সমাপ্ত করেছেন। পরের বছর আবার সেখান থেকেই চেণ্ডা বাদ্যযন্ত্রে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়েছেন। রাধাকৃষ্ণনের দাবি, সাইটে বলা হয়েছে ওই অধ্যাপক ‘কেরালা কলামণ্ডলম ডিমড্ বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ডিগ্রিগুলি পেয়েছেন। কিন্তু যে সময় সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক ওই ডিগ্রিগুলি পান, তখন ওই প্রতিষ্ঠান ডিমড্ বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা পায়নি। ঘটনা হল, প্রায় শতাব্দী প্রাচীন ওই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানটি বহু দিন কেরালা রাজ্য সরকারের সংস্কৃতি দফতরের আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে কাজ করেছে। ২০০৬ সালে কেন্দ্র সরকার প্রতিষ্ঠানকে ‘ডিমড্ ইউনিভার্সিটি আন্ডার আর্ট অ্যান্ড কালচার’-এর আওতায় আনে। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠানটিকে ‘এ’ শ্রেণির স্ট্যাটাসও দেয়। তদন্ত কমিটির যদিও যুক্তি, অভিযুক্ত অধ্যাপকের ওই প্রতিষ্ঠান স্কুল না ডিমড্ বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিশ্ববিদ্যালয়, তা বিচার্য বিষয় নয়। যদিও বিশ্বভারতীরই একাংশের মত, তদন্তে চাকরিপ্রার্থীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দেওয়া তথ্য তদন্ত কমিটির অবশ্যই যাচাই করে দেখা উচিত ছিল। যদি দেখা যায়, গোড়াতেই গলদ তা হলে ওই নিয়োগকে নির্ভুল বলা হবে কোন যুক্তিতে?
এ দিকে, অভিযোগকারীর দাবি, সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক আদতে এক জন চেণ্ডা শিল্পী। ওই চেণ্ডা আসলে কথাকলি নৃত্যের সহায়ক বাদ্যযন্ত্র রূপে ব্যবহৃত হয়। সে দিক থেকে কোন যুক্তিতে এক জন চেণ্ডা বাদককে কথাকলি নৃত্যের অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়েছে, তা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। এমনকী, বিশ্বভারতীর কথাকলি নৃত্য বিভাগের স্নাতক স্তরে চেণ্ডা নামক কোনও বিষয় নেই বলেও তাঁরা দাবি করেছেন। রাধাকৃষ্ণানের কটাক্ষ, “রবীন্দ্র নৃত্যের সময়ে এস্রাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তার মানে কি রবীন্দ্র নৃত্যের শিক্ষক হিসেবে বিশ্বভারতী এক জন এস্রাজ শিল্পীকে নিয়োগ করবে!” তবে, বিশ্বভারতীতে নিয়োগ নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ এই প্রথম নয়। অতীতেও এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে জাল মার্কশিট জমা করে চাকরি করার অভিযোগ উঠেছিল। যা মামলা-মোকদ্দমা অবধি গড়িয়েছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রাক্তন এক উপাচার্যকে জেলও খাটতে হয়। ঘটনা হল, গত কয়েক মাসে বিশ্বভারতীর ওই একই ভবনের বেশ কয়েকটি বিষয়ে একাধিক ক্ষেত্রে অধ্যাপক পদে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্য আবেদনকারীরা নিয়োগের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও করেছেন। সম্প্রতি ওই ভবনে নাটক বিভাগে বাংলার এক অধ্যাপককে নিয়োগের ব্যাপারেও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক অবন্তি চক্রবর্তী ওই পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “বিশ্বভারতীর আবেদনে বলা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এমএ অথবা দশ বছরের পেশাদার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আমার এমএ ভাষাতত্ত্ব নিয়ে। কিন্তু পেশাদার থিয়েটারে আমার দশ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু বাংলার যে অধ্যাপককে ওই পদে নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁর ওই অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে আমার জানা নেই।”
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বভারতীর অধ্যাপকসভার সভাপতি কিশোর ভট্টাচার্য বলছেন, “একাধিক নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে। অনেকে হাইকোর্টে মামলাও করেছেন শুনেছি। বারবার অভিযোগ উঠলে আদতে বিশ্বভারতীরই সুনাম ক্ষুন্ন হয়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।” বারবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি অভিযুক্ত অধ্যাপক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy