অবশেষে মুক্ত পরিজনেরা। সিউড়ি আদালতে। নিজস্ব চিত্র।
চলন্ত মোটরবাইক আটকে টাকা লুঠ করে কারা খুন করেছিল দুবরাজপুরের ব্যবসায়ী মৃণালকান্তি ওঝাকে?
তার উত্তর দিতে পারল না বীরভূম পুলিশের তদন্ত। সাড়ে চার বছর আগে সাড়া ফেলে দেওয়া ওই খুনের ঘটনায় তথ্যপ্রমাণের অভাবে ছয় অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করল সিউড়ি আদালত। বুধবার ওই রায় শুনিয়েছেন সিউড়ি দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা বিচারক মহানন্দ দাস। আর তার পরেই প্রশ্নের মুখে পুলিশের তদন্ত। স্বাভাবিক ভাবেই আদালতের রায়ে হতাশ নিহতের পরিবার। তদন্তে গাফিলতির জন্যই এমনটা হল বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন নিহতের পরিজনেরা। অন্য দিকে, অবশেষে বিচার মিলল বলে মনে করছেন অভিযুক্তদের পরিজনেরা।
২০১২ সালের ৩০ অগস্ট দুবরাজপুর ব্লক অফিসের কাছে ঘটে যাওয়া ওই নৃশংস ঘটনাটি এখনও দগদগে নিহতের পরিবারের স্মৃতিতে। পেশায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসায়ী শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মৃণালকান্তি ওঝা (৪৫) ওরফে রামু সে দিন ভোরে কলকাতা যাবেন বলে একটি মোটরবাইকে করে দুবরাজপুর স্টেশনে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মৃণালবাবুর ভাই চম্পক এবং দোকানের এক কর্মী লাল্টু নায়ক। মৃণালবাবুর সঙ্গে ছিল নগদ টাকা ভর্তি অ্যাটাচি। মোটরবাইক চালাচ্ছিলেন চম্পকবাবু। হঠাৎ-ই পথ আটকায় কিছু দুষ্কৃতী। টাকা ভর্তি অ্যাটাচি কেড়ে নিতে গিয়ে বাধা পেতেই তারা মৃণালবাবুর মাথায় গুলি চালিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই ব্যবসায়ীর। দুষ্কৃতীদের আক্রমণে মারাত্মক জখম হন চম্পকবাবুও। শহরের মধ্যে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনা তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। তদন্তে ছুটে এসেছিলেন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তারা।
তদন্তে নেমে পুলিশ দেখে— তিন জনের মধ্যে এক জন মারা গিয়েছেন। এক জন মারাত্মক জখম হয়েছেন। কিন্তু কীভাবে গায়ে আঁচড়টি না লাগিয়ে ছুটে পালাতে সফল হলেন লাল্টু, তার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে পুলিশ। সেই সূত্র ধরেই তদন্তে সাফল্য মেলে বলে দাবি করেছিল পুলিশ। মোবাইলের কললিস্ট দেখে ওই বছর ডিসেম্বরে পুলিশ লাল্টু ও পাড়ুই থানা এলাকার উত্তম সাহা নামে এক যুবককে ধরে। এর পরে সিউড়ির চার যুবক— দুলাল দলুই, ফুঁলচাঁদ দলুই, শিবনাথ তুড়ি এবং অনুভব মণ্ডল নামে আরও চার যুবকও ধরা পড়ে। পুলিশেরর দাবি, মৃণালবাবুর গতিবিধি থেকে অপরাধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা— সবই খুব দক্ষতার সঙ্গে করেছিল লাল্টুই। বাকিরা ঘটনার দিন অপারেশন চালিয়েছিল। চম্পকবাবু পরে সুস্থ হয়ে সিউড়ি সংশোধনাগারে ধৃতদের শনাক্তও করেন। ধৃতেরা জেল হাজতে থাকতে থাকতেই চার্জশিট দেয় পুলিশ। ২০১৩ সাল থেকে চলছিল বিচার প্রক্রিয়া।
এত কিছুর পরেও অভিযুক্তেরা ছাড়া পাওয়ায় প্রশ্নের মুখে পুলিশি তদন্ত। আইনজীবীদের একাংশের চোখে, তদন্তে ফাঁক ফোঁকর থাকার জন্যই এমন রায়। গর্ভমেন্ট পিপি রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কেবল বলেন, ‘‘মোট ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতেই বিচারক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’’ পুলিশি তদন্তের গাফিলতি নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। স্বভাবতই হতাশ নিহতের পরিবার। চম্পকবাবু, মৃণালবাবুর স্ত্রী শম্পা, কাকা কান্তিরাম ওঝারা বলছেন, ‘‘আমরা সত্যিই খুব হতাশ। কী ভাবে বিচার পাব বুঝে উঠতে পারছি না।’’ তাঁদের প্রশ্ন, মৃণালবাবুকে কে তা হলে কেউ খুন করেনি? ওই হত্যাকাণ্ডে বিচার চেয়ে অবিলম্বে উচ্চ আদালতে আর্জি জানাবেন চম্পকবাবুরা।
উল্টো দিকে, রায়কে স্বাগত জানিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মক্কেলদের মিথ্যা নালিশে ফাঁসানোর অভিযোগ করছেন অভিযুক্তদের আইনজীবী সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, শিবসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়রা। তাঁদের দাবি, ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্তদের কোনও সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও যেমন করে হোক অভিযুক্তদের উপর মিথ্যা দায় চাপিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের। মামলা সাজানোয় বিস্তর ফাঁক থেকে যাওয়াতেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কেমন সেই সাজানো? সোমনাথবাবুরা বলছেন, ‘‘প্রথমত, পুলিশ বলেছিল, রাস্তার ধারে সাত দিন ধরে পড়ে থাকা একটি মোটরবাইক তারা উদ্ধার করেছে। এটা বিশ্বাসযোগ্য? দ্বিতীয়ত, অভিযুক্তদের ঠিক ভাবে টিআই প্যারেডই হয়নি। তৃতীয়ত, অভিযুক্তদের কাছ থেকে টাকা বা অ্যাটাচি, কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, ২০১৩ সালে সিজ করা একটি প্রমাণকে (যা আদালতে দাখিল হয়েছে) ২০১৫ সালের সংবাদপত্র দিয়ে মোড়া অবস্থাতেও পাওয়া গিয়েছে।’’
পুলিশের তদন্তের এমন হাল কী করে হল, তার অবশ্য কোনও ব্যাখ্যা তাদের তরফে মেলেনি। জেলার বর্তমান পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার শুধু বলেন, ‘‘আদালতের রায়ের কপি না দেখে কোনও মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’’ এ দিকে, লাল্টুর পরিবার প্রথম থেকেই দাবি করে এসেছিল, তাঁদের ছেলে নির্দোষ। রায়ের পর স্বভাবতই খুশি লাল্টু এবং বাকিদের পরিবার। এ দিন রায়ের পরে অভিযুক্তদের মুক্তির আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিজনেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy