Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ওঝার শরণ নিয়ে মৃত্যু সর্পদ্রষ্ট বধূর

বরাবাজার থানার সিন্দরি বাজার এলাকায় স্বামী এবং তিন ছেলে মেয়ের সঙ্গে থাকতেন ঝুনু। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়িতে অতিথি আসায় শুক্রবার রাতে ঝুনু মেঝেতে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ কিছুর কামড়ে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। অন্যদের বলতে সবাই মিলে আলো নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে ঘরের মধ্যে একটি চিতি সাপ পান। সাপটিকে মেরে ফেলা হয়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মানবাজার শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০১:৪৩
Share: Save:

বাড়ির ঠিক পাশেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু সাপ ছোবল মারার পরে সেখানে না গিয়ে ডেকে আনা হয়েছিল স্থানীয় এক ওঝাকে। ঝাড়ফুঁকের পরে শেষ পর্যন্ত যখন সর্পদ্রষ্ট বধূকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় তখন চিকিৎসকদের বিশেষ কিছু করার ছিল না। শনিবার বারি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঝুনু মাহাতো (৩৮) নামে ওই বধূর মৃত্যু হয়।

বরাবাজার থানার সিন্দরি বাজার এলাকায় স্বামী এবং তিন ছেলে মেয়ের সঙ্গে থাকতেন ঝুনু। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়িতে অতিথি আসায় শুক্রবার রাতে ঝুনু মেঝেতে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ কিছুর কামড়ে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। অন্যদের বলতে সবাই মিলে আলো নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে ঘরের মধ্যে একটি চিতি সাপ পান। সাপটিকে মেরে ফেলা হয়। এক পড়শির দাবি, তাঁরা এসে দেখেন ঝুনুর স্বামী সমর মাহাতো ওঝাকে ডাক পাঠিয়েছে। অভিযোগ, পাশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে বলা হলে সমর কথা কানে তোলেনি। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র রাতে বন্ধ থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীরা কাছেই থাকেন। ডাকাডাকি করলে রাত বিরেতেও চলে আসেন। পড়শিদের একাংশের দাবি, সমর ওঝা ডাকার ব্যাপারেই গোঁ ধরেছিল।

স্থানীয় এক ওঝা আসে। রাতভর কসরৎ করার পরেও কাজ না হওয়ায় ক্ষান্ত দিয়ে ফিরেও যায়। ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে। ওই বধূর শারীরীক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করেছে। তখন পড়শিরাই ট্রাক্টর জোগাড় করে ঝুনুকে তাতে চাপিয়ে নিয়ে যান বারি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় ওই বধূর। সমরের বক্তব্য, ‘‘সাপ ছোবল মারার পরে অনেকে ঝাড়ফুঁকে সেরে গিয়েছে বলে শুনেছি। তাই চেষ্টা করেছিলাম।’’ পড়শিদের একাংশের দাবি, সমর মদ্যপ। প্রায় সারাক্ষণ নেশার ঘোরে থাকে। কাজকর্মও বিশেষ করে না। ঝুনুই দিন মজুরি করে সংসার চালাতেন। পুলিশ ওই বধূর বাপের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। শনিবার দেহটির ময়নাতদন্ত হয়েছে। রুজু হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা।

সিন্দরি পঞ্চায়েতের প্রধান বিশ্বজিৎ মাহাতো বলেন, ‘‘সিন্দরি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশেই সমরের বাড়ি। শুনেছি কাল রাতে ঝুনুকে সাপে কামড়ানোর পরে ওর স্বামী ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করিয়েছে। সময় মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে হয়তো ঝুনুকে এ ভাবে মরতে হত না। রাতে আমাকে জানালে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করে দিতাম।’’ এই ব্যাপারে সচেতনতার অভাবকেই দায়ি করছেন বিজ্ঞান মঞ্চের কর্মীরা। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁরা ওই গ্রামে গিয়ে ওই বধূর পরিবার ও পড়শিদের সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁদের সচেতন করা হবে। পাশাপাশি ওই ওঝাকে খুঁজে বের করে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হতে পারে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

বারাবাজার ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক স্বপন সিংহ সর্দার বলেন, ‘‘ওই বধূকে খুবই দেরি করে আনা হয়েছিল। অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক ছিল।’’ সাপের ছোবলে বিভিন্ন জেলায় মৃত্যুর ঘটনা লেগেই থাকে। মাথা ঠান্ডা রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে অনেক সময়েই সর্পদ্রষ্টকে বাঁচানো সম্ভব বলে জানাচ্ছেন জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা। তাঁরা জানান, এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা হল অ্যান্টিভেনম (এভিএস)। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে যত দ্রুত এই ওষুধ প্রয়োগ করা হবে, সর্পদষ্টকে বাঁচানো তত সহজ হবে। জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, “সাপের ছোবলে প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করলে মারাত্মক হতে পারে। এক মিনিট নষ্ট হলে কিডনি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশ বেড়ে যায়।’’ ওই স্বাস্থ্যকর্তার পরামর্শ, সাপের ছোবলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ক্ষতস্থানে শক্ত বাঁধন দেওয়ারও দরকার নেই। ক্ষতস্থান ব্লেড বা ছুরি দিয়ে কাটা যাবে না, দেওয়া যাবে না বরফ বা জল।

কিন্তু অনেক সময়ে ওঝাদের হাত ঘুরে সর্পদ্রষ্টরা যতক্ষণে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে পৌঁছন, অনেক দেরি হয়ে যায়। সে জন্য সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার স্বাস্থ্য দফতর ওঝাদের প্রশিক্ষণ দিতে শিবির করছে। সেখানে ওঝাদের বোঝানো হচ্ছে, পুরনো ধ্যানধারণা আঁকড়ে থাকলে হিতে বিপরীত হয়। ঝাড়ফুঁক করে সর্পদষ্টকে বাঁচানো যায় না। প্রাণ বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই একমাত্র রাস্তা।

কিন্তু পুরুলিয়ায় এখনও এই ধরণের কোনও উদ্যোগ হয়নি বলে জানান জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অনিল দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘আমরা জেলা জুড়ে অনেক গ্রামীণ চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এই সমস্ত ঘটনায় তাঁদের কাছেও অনেকে যান। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সর্পদ্রষ্ট রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠাবেন।’’ তবে ওঝাদের খুঁজে বের করে কেন্দ্রীয় ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া সহজ নয় বলে তাঁর দাবি। তিনি জানান, এই ব্যাপারে দফতরের কোনও নির্দেশও আসেনি।

• ক্ষতস্থান স্থির রাখতে হবে

• শরীরে বাঁধা জিনিস যেমন চুড়ি, হাতঘড়ি খুলে ফেলতে হবে

• দ্রুত পৌঁছতে হবে হাসপাতালে

• ক্ষতস্থানে বরফ লাগাবেন না

• লাগানো যাবে না রাসায়নিক

• বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE