বাম আমলে কথা উঠেছিল তারাপীঠকে কেন্দ্র করে তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন সংস্থা (ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) গড়ে উঠবে। সেই মতো প্রস্তাব জেলা প্রশাসন এবং তৎকালীন রাজ্য সরকারের কাছে এলাকার দুই বিধায়ক হাসন বিধানসভা কেন্দ্রের অসিত মাল ও রামপুরহাটের আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার বিধানসভায় উত্থাপন করেছিলেন। শেষমেষ তারাপীঠ-রামপুরহাট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির প্রস্তাব আপাতত বাদ দিয়ে তারাপীঠকে আলাদা ভাবে বর্তমান সরকার পুরসভা হিসেবে ঘোষণা করল। সেই সঙ্গে ময়ূরেশ্বর থানার মল্লারপুরও পুরসভা হিসেবে ঘোষিত হল।
বুধবার বিধানসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “আগের সরকার অনেক পুরসভা তৈরি করেছে। সেগুলির কোনও পরিকাঠামো নেই। বর্তমান সরকার সেই পথে হাঁটতে রাজি নয়। পরিকাঠামো তৈরি করে তবেই পুরসভা করব।” এ দিন বীরভূমের তারাপীঠ ও মল্লারপুর ছাড়াও রাজ্যের আরও ২০ মতো এলাকাকে পুরসভা গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন পুরমন্ত্রী।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, তারাপীঠ পুরসভা মূলত চণ্ডীপুর, নবগ্রাম, কড়কড়িয়া, তারাপুর, কামদেবপুর এই পাঁচটি মৌজা নিয়ে গড়ে উঠছে। তারাপীঠ মূলত চণ্ডীপুর মৌজার মধ্যে পড়ছে। আর নবগ্রাম মৌজার মধ্যে পড়ছে সরলপুর, কুঁজোপাড়া, হাজিপুর, ডাঙাপাড়া এই সমস্ত গ্রাম। কড়কড়িয়া মৌজার মধ্যে পড়ছে কড়কড়িয়া, জুনিদপুর, তেঘড়ি গ্রাম। তারাপুর মৌজার মধ্যে পড়ছে তারাপুর, ফুলিডাঙা-সহ আরও কিছু এলাকা। এই সব এলাকা বর্তমানে রয়েছে মাড়গ্রাম থানার সাহাপুর পঞ্চায়েতের মধ্যে রয়েছে। আবার কামদেবপুর মৌজার মধ্যে কামদেবপুর, কবিচন্দ্রপুর, নওয়াপাড়া, চকআটলা গ্রামগুলি বর্তমানে রামপুরহাট ১ ব্লকের খরুণ পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে রয়েছে। রামপুরহাট মহকুমা প্রশাসনিক দফতর সূত্রে জানা যায়, তারাপীঠে কম করেও ৫০০ হোটেল আছে। পাঁচটি মৌজার বাসিন্দা-সহ তারাপীঠ এলাকার বাসিন্দাদের ধরে কম করে ৩০ হাজারের বেশি লোকসংখ্যা নিয়ে পুরসভা করার প্রস্তাব বেশ কিছু দিন আগে সরকারের কাছে দেওয়া হয়। পঞ্চায়েতের অনুমোদনের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্য সরকারের পুরউন্নয়ন দফতর সেই প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতে পাঠায়। পঞ্চায়েত থেকে সেই কাগজপত্র পাঠানো হয় জেলাশাসকের মাধ্যমে রাজ্যের পুরদফতরে। শেষ মেষ বুধবার পুরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পুরসভা হিসেবে ঘোষণার আগে তারাপীঠের যে ভৌগলিক অবস্থান, তাতে তারাপীঠে দ্বারকা নদের উপর যে সেতু সেই সেতু এলাকাকে দু’ভাগে ভাগের মধ্যে পড়ে। একভাগ রামপুরহাট থানা ও রামপুরহাট ১ ব্লকের খরুণ পঞ্চায়েতের অধীন, আর একভাগ মাড়গ্রাম থানা ও রামপুরহাট ২ ব্লকের সাহাপুর পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। এর ফলে তারাপীঠে কোনও ঘটনা ঘটলে পুলিশ-প্রশাসনকে আগে খোঁজ নিতে হবে এলাকাটি কোন থানা বা কোন ব্লক বা কোন পঞ্চায়েতের অধীন। এমনকী তারাপীঠ শ্মশানের জায়গা নিয়েও দুই পঞ্চায়েতের মধ্যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিরোধ দেখা গিয়েছিল। পুরসভা ঘোষণা হওয়ায় সেই সব সমস্যা মিটবে বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রশাসন থেকে এলাকার বাসিন্দারা।
শুধু তাই নয়, তারাপীঠের উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুই ব্লকের বিডিও, দুই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও সদস্য, পঞ্চায়েতের প্রধান ও সদস্যদের ডেকে সভা করতে হয়। পুরসভা হওয়ার পর সেই ঝামেলা নিতে আর হবে না। তারাপীঠকে পুরসভা হিসেবে ঘোষণা করার পরে রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক আশিসবাবু বলেন, “তারাপীঠের উন্নয়নের জন্য এই ঘোষণা খুবই দরকার ছিল।” তারাপীঠের বাসিন্দা তথা তৃণমূলের ২ ব্লক সভাপতি সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “তারাপীঠে দু’টি বুথ। প্রায় সাড়ে চার হাজার ভোটার। জনসংখ্যা প্রায় কুড়ি হাজার। সেখানে এত মানুষকে পানীয় জলের পরিষেবা, তারাপীঠ এলাকায় রাস্তার আলো, আবর্জনা পরিষ্কার, নিকাশি ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন এসব পঞ্চায়েত থেকে করতে হয়। উন্নয়নের নিয়ে অনেক ক্ষোভ জমা হয়। পুরসভা হলে সেই ক্ষোভ আশা করি হবে না। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ায় ভীষণ খুশি।”
তারাপীঠ তারামাতা মন্দির কমিটির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “পুরসভা ঘোষণার পর আশা রাখি এলাকায় যে নাগরিক সমস্যা আছে সেগুলি এতদিন ঘুচবে।” তারাপীঠের বাসিন্দা পুলক চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এটা অনেক আগেই দরকার ছিল। তবে তারাপীঠে পৃথক থানা গড়ে তোলার যে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি, সেই দাবি অবিলম্বে পূরণ করা হোক।”
অন্য দিকে, মল্লারপুর পুরসভার মধ্যে মল্লারপুর ১, মল্লারপুর ২ এই দুই পঞ্চায়েতের সম্পূর্ণ এলাকা এবং কানাচি পঞ্চায়েতের মহুলা, ভেলিয়ান, তিলডাঙা, গুরচন্দ্রপুর, কুমুড্ডা এলাকা পড়ছে। মোট ৩৯টি মৌজার প্রায় চল্লিশ হাজার বাসিন্দাদের নিয়ে এই পুরসভা গঠিত হচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।
মল্লারপুরের বাসিন্দা তথা ময়ূরেশ্বর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মল্লারপুরবাসীকে সমস্ত কিছু নাগরিক পরিষেবা এতদিন ধরে পঞ্চায়েত থেকে দিতে হত। প্রতি বছর ২ লক্ষ টাকা এলাকার নিকাশি ব্যবস্থার জন্য খরচ করতে হয়। এই সমস্ত খরচ পঞ্চায়েত সমিতি, পঞ্চায়েতের আয় থেকে করা হত। এ বারে পুরসভা হওয়ার ফলে পানীয় জল, রাস্তা সংস্কার, নিকাশী ব্যবস্থা, জঞ্জাল সাফাই সব কিছু পুরসভা থেকে করা হবে। এতে অনেক লোকের কর্মসংস্থান যেমন হবে, তেমনি এলাকার উন্নতি ও হবে। এলাকাবাসীর দাবি মেনে পুরসভা ঘোষণা করায় আমরা খুশি।” জেলাশাসক পি কে মোহন গাঁধী বলেন, “আমি সদ্য এই জেলায় এসেছি। এলাকাগুলির সঙ্গে পরিচয় নেই। তবে দ্রুত জায়গাগুলি দেখে রাজ্য সরকারের নির্দেশ মতো কাজ করা হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy