ব্যবসায়ী সমিতির পুজো কীর্ণাহারে।—নিজস্ব চিত্র।
বছরভর প্রতিদিন এক টাকা করে জমানো হয়। সেই জমানো টাকা দিয়েই পুজোর আয়োজন করেন কীর্ণাহার সব্জি ব্যবসায়ীরা।
ওই পুজোয় আলোর জৌলুস নেই, নেই বাহারি মণ্ডপও। তবু সহমর্মিতার আলোকে উজ্জ্বল কীর্ণাহার সব্জি ব্যবসায়ীদের লক্ষ্মীপুজো। পাশাপাশি জমানো টাকা দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াতেও কাজে লাগানো হয়। ওই ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই রাস্তার ধারে বসে সব্জি বিক্রি করেন। নিজেদের জীবনযন্ত্রণার অভিজ্ঞতাই তাঁদের এমন উত্তরণ ঘটিয়েছে। তাই আর্থিক সম্বল না থাকলেও ওঁরা এ ভাবেই লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করে আসছেন।
দিনের শেষে আড়তদারের পাওনা মিটিয়ে হাতে যা থাকে, তা দিয়ে ওই সব্জি ব্যবসায়ীদের নিজেদেরই সংসার চলে না। তাঁদের একার পক্ষে পুজোর খরচ জোগানো একটা দুঃসাধ্য কাজ। ওই ব্যবসায়ীরা জানালেন, লক্ষ্মীপুজো করার ব্যাপারে ৩৫ বছর আগে এক উপায় বের করে সব্জি ব্যবসায়ীদের সংগঠন লক্ষ্মী-নারায়ণ সমিতি। স্থির হয়, সব্জি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিয়েই পুজোর খরচ জোগাড় করা হবে। সামিল করা হয় কৃষিজীবিদেরও। কীর্ণাহারে ছ’টি সব্জি আড়ত রয়েছে। বিভিন্ন এলাকার চাষিরা উত্পাদিত সব্জি সেখানেই বিক্রি করেন। নির্দিষ্ট কমিশন কেটে আড়তদারেরা তা খুচরো বিক্রির জন্য তুলে দেন ছোট ব্যবসায়ীদের হাতে। ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনের ইচ্ছের কথা জানান। চাষিরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ঠিক হয়, কম বেশি যত পরিমাণ সব্জিই চাষিরা বিক্রি করুন না কেন, তাঁরা দৈনিক ১ টাকা করে ‘ঈশ্বরবৃত্তি’ হিসাবে দেবেন। সেই টাকা জমিয়ে রাখা হবে। পুজোর আগে সাধ্য অনুযায়ী চাঁদা দেবেন সব্জি বিক্রেতারাও। ৩৫ বছর আগে চালু হওয়া ওই প্রথা আজও চলছে। এমন আয়োজনে খুশি বালিয়াড়ার সব্জি চাষি উজ্জ্বল মণ্ডল, মহুলার অমর মণ্ডলরা বলেন, “সব্জি বিক্রি করতে গিয়ে আমাদের কোনও ঝক্কি পোহাতে হয় না। তাই ১ টাকা দিতে আমাদের গায়ে লাগে না। তা ছাড়া আমারা ওই পুজোয় সামিলও হতে পারছি।”
শুধু পুজোই নয়, উদ্বৃত্ত টাকা লাগানো হয় জনকল্যাণেও। সমিতির সম্পাদক শ্যামল মজুমদার জানান, পুজোর আড়ম্বর কমিয়ে টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। সমিতির সদস্যরা কেউ বিপদে পড়লে ওই উদ্বৃত্ত টাকা ধার কিংবা অনুদান হিসাবে দেওয়া হয়। সমিতির সদস্যরাই শুধু নন, দুঃস্থদেরও সাহায্য করা হয় বলে শ্যামলবাবু জানিয়েছেন। তবে, সমিতির সভাপতি রাধাশ্যাম সাহার আক্ষেপ, “গত ৫ বছর ধরে পুজোর খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। কিছুতেই টাকা বাঁচানো যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে সাহায্যপ্রার্থীদের খালি হাতে ফেরাতে হচ্ছে।”
তবে, উপকারের সেই দিনগুলি আজও ভোলেননি লাভপুরের বিধবা আরতি দাস, আমড়ার বিশ্বনাথ বাগদীরা। বছর কয়েক আগে মেয়ের বিয়ের সাহায্যের জন্য সমিতির দ্বারস্থ হয়েছিলেন আরতিদেবী। ছেলের চিকিত্সার জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন বিশ্বনাথবাবু। তাঁরা বলছেন, “সে দিন সমিতি যে ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তা কোনও দিন ভুলব না।” সব্জি বিক্রেতা চিগ্রামের নিখিল দাস, দরবারপুরের নিজাম শেখরাও জানান, সময়ে-অসময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁরা ধার কিংবা অনুদান পেয়েছেন। তার জন্য কোনও চড়া সুদ গুনতে হয়নি। এ ভাবেই কীর্ণাহার এলাকার বহু চোখ ধাঁধানো মণ্ডপের পাশে উজ্জ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিতান্তই সাদামাটা সন্ন্যাসী দাস, লাল্টু কর, সমর সাহাদের ওই লক্ষ্মীপুজোর মণ্ডপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy