Advertisement
E-Paper

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে রাইপুর

রাজা মহারাজাদের স্মৃতি বিজড়িত গড় রাইপুর এক সময় ছিল বাংলার বিপ্লবীদের অন্যতম ডেরা। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই রাইপুর। ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে চুয়াড় বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল জঙ্গলমহলের এই জনপদে। সেই সব ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাতায় আজও রয়ে গিয়েছে।

দেবব্রত দাস

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:১২

রাজা মহারাজাদের স্মৃতি বিজড়িত গড় রাইপুর এক সময় ছিল বাংলার বিপ্লবীদের অন্যতম ডেরা।

ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই রাইপুর। ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে চুয়াড় বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল জঙ্গলমহলের এই জনপদে। সেই সব ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাতায় আজও রয়ে গিয়েছে।

জঙ্গলমহলের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন, সাতপাট্টা দেমুশন্যা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক সজলকান্তি মণ্ডল। তাঁর কথায়, ১৭৬০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরকাশিমের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। গড় রাইপুর সেই সময় বর্ধমান পরগনার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ওই চুক্তিবলে ১৭৬৭ সালে লেফটেন্যান্ট ফাগুর্সন জঙ্গলমহলের কয়েকটি অঞ্চল দেখাশোনার দায়িত্ব পান। ওই অঞ্চলে সুপুর, ফুলকুসমা, অম্বিকানগরের সঙ্গে রাইপুরের জমিদারিও ছিল। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বকেয়া খাজনা মেটাতে ব্যর্থ হন রাজা দুর্জন সিংহ।

১৭৯৩ সালের ১৯ জুলাই দুর্জন সিংহ নিজেকে রাইপুরের স্বাধীন তালুকদার বলে ঘোষণা করেন। এর পরেই কোম্পানি ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্জন সিংহকে বন্দি করার নির্দেশ দেয়। ১৭৯৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সরকারি এক নির্দেশে রাইপুর, শ্যামসুন্দরপুর-সহ ৬টি জঙ্গলমহাল তদানীন্তন মেদিনীপুর জেলায় স্থানান্তরিত হয়। আর ৫৭টি গ্রামকে নিয়ে রাইপুর জমিদারি নিলামে ডাকার বন্দোবস্ত করা হয়। দুর্জন সিংহ অবশ্য এই নিলামের বিরুদ্ধে জেলা কালেক্টরিতে এবং জেলা আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য তা অগ্রাহ্য হয়। কিন্তু তাতে দমে যাননি দুর্জন সিংহ। ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে রাইপুর পরগনায় শুরু হয় চুয়াড় বিদ্রোহ। সেই সময়ে দুর্জন সিংহ ওই বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দেড় হাজার চুয়াড় সেনা নিয়ে তিনি রাইপুর পরগনার ৩০টি গ্রামের উপর নিজের দখলদারি কায়েম করেন।

পরে তিনি এই সশস্ত্র আন্দোলনকে বগড়ির চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গে সামিল করেছিলেন। বিদ্রোহীদের আক্রমণে ব্রিটিশ শাসকের নিযুক্ত জমিদার, নায়েব, গোমস্তারা এবং থানার দারোগা-সহ পুলিশ কর্মীরা প্রাণভয়ে রাইপুর ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে এই পরিস্থিতি স্থায়ী হয়নি। পরে সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের হটিয়ে পুনরায় রাইপুর দখল করে। চুয়াড় বিদ্রোহের সময়ে দুর্জন সিংহ-কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁর সেই বীরত্বের স্মরণে রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতির ভবনের নাম রাখা হয়েছে রাজা দুর্জন সিংহের নামে।

শুধু চুয়াড় বিদ্রোহই নয়, পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের আরও লড়াইয়ের সাক্ষী এই রাইপুর। ইতিহাসের পাতায় তার উল্লেখ রয়েছে। ১৯৩০ সালে বিপ্লবী সুশীল পালিত পায়ে হেঁটে গোপনে রাইপুরে এসে আইন অমান্য আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তারই জেরে ১৯৩২ সালে বাঁকুড়ার মহিলা বিপ্লবীরা দু’টি থানা দখলের চেষ্টা করেছিলেন। তারমধ্যে একটি ছিল রাইপুর থানা। বিপ্লবী আশালতা রায়ের নেতৃত্বে রাইপুর থানার দারোগার বাড়ি থেকে একটি রিভলবার ছিনতাই করা হয়।

১৯৩৭ সালে বাঁকুড়ায় হিন্দু মহাসভার শাখা গঠিত হয়। ১৯৪০ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রথম বাঁকুড়া জেলায় এসেছিলেন। সেই সময় তিনি রাইপুরের একটি জনসভায় ভাষণ দিয়ে এলাকার মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। ১৯৪২-র অগস্ট আন্দোলনে ফের গর্জে উঠেছিল রাইপুর। বিপ্লবী আশালতা রায়ের নেতৃত্বে মহিলারা রাইপুর পোস্ট অফিসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রাইপুরের জনপ্রিয় বিপ্লবী দেবাদিদেব দে-কে এই সময়ে কারাবন্দি করে রেখেছিল ইংরেজ পুলিশ। জানা যায়, সেই সময়ে কংগ্রেসের বহু নেতা রাইপুরে গিয়ে ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন।

স্থানীয় বিপ্লবী বৈদ্যনাথ সাঁওতাল, কিনু সাঁওতাল, স্বরূপ মাঝিদের নেতৃত্বে জঙ্গলমহলের হাজার হাজার মানুষ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে চুয়াড় বিদ্রোহ, স্বাধীনতা আন্দোলন সব মিলিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ডেরায় পরিণত হয়েছিল সে দিনের রাইপুর। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া এইসব কাহিনী আজও মুখে মুখে ঘুরছে রাইপুরের আনাচে কানাচে। ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা রাইপুরের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহণ করে চলেছে।

amar shohor amar sohor raipur debabrata das
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy