Advertisement
E-Paper

রং পাল্টেছে, বদলায়নি গ্রামের চরিত্র

সময় বদলেছে। বদলেছে রং-ও। কিন্তু চরিত্র বদলায়নি কুসুমগড়িয়া ও বামনি গ্রামের। এক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের সংঘর্ষ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আজও সেই জায়গাতেই আটকে রয়েছে দু’টি গ্রাম। রবিবার বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে দুই দুষ্কৃতীর। বস্তুত বোমাবাজি, হানাহানির ইতিহাস দু’টি গ্রামের দীর্ঘদিনের।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০১:০৭

সময় বদলেছে। বদলেছে রং-ও। কিন্তু চরিত্র বদলায়নি কুসুমগড়িয়া ও বামনি গ্রামের। এক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের সংঘর্ষ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আজও সেই জায়গাতেই আটকে রয়েছে দু’টি গ্রাম। রবিবার বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে দুই দুষ্কৃতীর। বস্তুত বোমাবাজি, হানাহানির ইতিহাস দু’টি গ্রামের দীর্ঘদিনের।

লাভপুরের চৌহাটা-মহোদরী ১ পঞ্চায়েতের পাশাপাশি দু’টি গ্রাম কুসুমগড়িয়া ও বামনি। এক সময়ে বামনি গ্রাম ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রভাবাধীন। আর কুসুমগড়িয়ায় প্রভাব ছিল সিপিএমের। বছরভর দু’টি গ্রামের দুই রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকত। প্রায় প্রতিটি ভোটে ফ্রন্টের শরিকি সৌজন্য রক্ষার খাতিরে কখনও আসন সমঝোতা করে কখনও বা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত সিপিএম, ফব। ভোটের পরে ফবকে উপপ্রধানের পদ দিয়ে পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন করত সিপিএম। কিন্তু তাতেও দু-পক্ষের বিবাদ মেটেনি। সরকারি প্রকল্পে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দু-পক্ষের ঝামেলা লেগেই থাকত। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় লড়াই থামাতে গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে বসাতে হয় পুলিশ ক্যাম্প। কিন্তু তাতেও লড়াই থামেনি।

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দু-পক্ষের গোলা, গুলিতে বামনি গ্রামের ফব-র মহিলা সমর্থক আহত হন। অভিযোগ ওঠে কুসুমগড়িয়ার সিপিএম সমর্থকদের বিরুদ্ধে। সে সময় লড়াই থামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয় ক্যাম্পের পুলিশ কর্মীরাও। ক্যাম্প লক্ষ করে বোমাবাজির অভিযোগ উঠেছিল। যার জেরে তুলে নেওয়া হয় গ্রামের পুলিশ ক্যাম্পও। ২০০৬-এর নভেম্বর মাসেও বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে হাসিবুল শেখ ওরফে লাল্টু নামে কুসুমগড়িয়ার এক ফব সমর্থকের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও দুই ফব সমর্থক। ওই সময়ে এলাকায় তৃণমূলের কোনও অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। এই চিত্রটা এখন পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। আসন্ন লোকসভা ভোটের মুখেও দু’টি গ্রামের ‘লালে’র কোনও চিহ্ন নেই বললেই চলে। বরং দু’টি গ্রামে সবুজের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

রাজনৈতিক এই পট পরিবর্তনের শুরু ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পর। ওই সময়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের হাত ধরে দল পরিবর্তন করেন দাঁড়কা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান তথা ফব-র দাপুটে নেতা মনিরুল ইসলাম। দলের সহ সভাপতির পদের পাশাপাশি লাভপুর বিধানসভা কেন্দ্রের টিকিট লাভ করেন মনিরুল। তিনি উদ্যোগী হয়ে কুসুমগড়িয়া গ্রামের সিপিএম কর্মী হিসেবে পরিচিত সাজাহান শেখ, আনোয়ার শেখদের দলে ঢোকান। বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হন মনিরুল। এর পরেই রাজনৈতিক গুরু হিসেবে পরিচিত ফব-র জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অব্দুল মান্নানকে তাঁরই ভাব শিষ্য মনিরুল দলে ঢোকান বলে রাজনৈতিক সূত্রের খবর। পরবর্তীকালে আব্দুল মান্নানের উদ্যোগে বামনি গ্রামের লালন শেখ, ইসমাইল শেখ, পটল শেখ-সহ ফব কর্মী-সমর্থকেরা তৃণমূলে ঢোকেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘গুরুশিষ্যের’ প্রচেষ্টায় লাভপুর এলাকার জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, এবং পঞ্চায়েতের সমস্ত আসনেই তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে। চৌহাটা-মহোদরী ১ পঞ্চায়েতে ফব এবং সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া প্রার্থীদের নিয়েই বোর্ড গঠন হয়। গুরু-শিষ্যের সুসম্পর্ক সর্বজনবিদিত। মনিরুলের অবর্তমানে এলাকায় দলের কাজ কর্ম দেখভাল করেন মান্নান। বিনিময়ে স্কুল, কলেজ, সমবায় সমিতি, পুলিশ প্রশাসনের ‘বকলমে’ গুরুকে দেন শিষ্য।

গুরু-শিষ্যের সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও মনিরুলের হাত ধরে তৃণমূলে ঢোকা কুসুমগড়িয়ার প্রাক্তন সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে আব্দুল মান্নানের হাত ধরে তৃণমূলে ঢোকা বামনি গ্রামের প্রাক্তন ফব কর্মী-সমর্থকদের বিরোধ মেটেনি। বরং পঞ্চায়েতের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে তা বেড়েই চলেছে বলে এলাকা সূত্রে জানা গিয়েছে। তারই জেরে রবিবার বামনি গ্রামের ইসামাইল শেখের বাড়ির পিছনে বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে দাঁড়কা পঞ্চায়েত এলাকার হাসেম শেখ এবং বরজাহান শেখ নামে দুই যুবকের মৃত্যু হয়। কুসুমগড়িয়ার সাজাহান শেখের দাবি, “পঞ্চায়তের সমস্ত কাজের এক তরফা দখলদারি নেওয়ার জন্য ওরা আমাদের আক্রমণ করতেই বোমা বাঁধছিল।” বামনি গ্রামের বাসিন্দা কংগ্রেসের অঞ্চল কমিটির সভাপতি তথা পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্য শেখ আবুল কাশেম বলেন, “সিপিএম এবং ফব কর্মী-সমর্থকেরা দল বদলে তৃণমূলে ঢুকলেও ওদের চরিত্র পাল্টায়নি। আগে পঞ্চায়েতের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের টাকা আত্মসাতের জন্য ফ্রন্টের দুই শরিক হানাহানি করত। এখনও সেই ধারা বজায় রেখেছে।” এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি মনিরুল ও মান্নান। এই ঘটনার জন্য বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে সরাসরি দায়ী করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাঁকে গ্রেফতারের দাবি তোলেন সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম।

এ দিকে মঙ্গলবার সিউড়িতে দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক বৈঠকে করেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মনিরুলের মতো নেতাদের উস্কানিতেই লোকসভা ভোটে সন্ত্রাস কায়েম করতে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা বোমা বাঁধছিল।” তিনি নিহতের পরিবারকে সরকারি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। তাঁর যুক্তি, “বোমা বাঁধার জন্য যাদের ভাড়া করে আনা হয়েছিল তাদের পরিবারের লোকেরা তো দোষী নয়। তা হলে তারা কেন ভেসে যাবে?” এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেন, “ওই সব দুষ্কৃতীরা ফব-র লোক। তৃণমূলকে আক্রমণ করার জন্যই বোমা বাঁধছিল। দুষ্কৃতীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা সিপিএমের মুখে শোভা পায়।”

lavpur cpm tmc
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy