Advertisement
০২ মে ২০২৪

লো-ভোল্টেজে বন্ধ পাম্প, সঙ্কটে বোরো চাষ

বৃষ্টি নেই। নদীতেও জল নেই। সাব মার্সিবল পাম্প থাকলেও লো-ভোল্টেজের জন্য পাম্প চালিয়ে খাল-বিলের জলও জমিতে ঢালা যাচ্ছে না। এর ফলে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বোরো চাষ সঙ্কটে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিকরাও সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ভোল্টেজের সমস্যা কবে মিটবে, সে জবাব মেলেনি। আর সেচের সমস্যার এই ইস্যুকে ধরেই ভোটারদের টানতে আসরে নেমেছেন বিরোধীরা।

শুকিয়ে যাচ্ছে ধান জমি।  —নিজস্ব চিত্র।

শুকিয়ে যাচ্ছে ধান জমি। —নিজস্ব চিত্র।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৪৩
Share: Save:

বৃষ্টি নেই। নদীতেও জল নেই। সাব মার্সিবল পাম্প থাকলেও লো-ভোল্টেজের জন্য পাম্প চালিয়ে খাল-বিলের জলও জমিতে ঢালা যাচ্ছে না। এর ফলে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বোরো চাষ সঙ্কটে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিকরাও সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ভোল্টেজের সমস্যা কবে মিটবে, সে জবাব মেলেনি। আর সেচের সমস্যার এই ইস্যুকে ধরেই ভোটারদের টানতে আসরে নেমেছেন বিরোধীরা।

নলহাটির কাঁটাগড়িয়া মোড়ে সম্প্রতি এক সভায় বক্তব্য রাখছিলেন বামফ্রন্টের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। হঠাৎ তিনি উপস্থিত জনতার কাছে জানতে চান, “আপনাদের এলাকায় নতুন করে বিদ্যুৎ পৌঁচেছে এমন এলাকা আছে?” মঞ্চের কাছে বসা একজন উঠে বললেন, “বিদ্যুৎ প্রায় সব গ্রামে পৌঁচেছে। কিন্তু লো-ভোল্টেজের জন্য মাঠের ধান যে মাঠেই মারা যাচ্ছে।” দলের নেতারা বললেন, “তাহলেই বুঝুন, রাজ্যে কী চলছে!”

শাসকদলের নেতারা অবশ্য রাজ্যে বিদ্যুতের পরিষেবা উন্নত হয়েছে বলে দাবি করছেন। কিন্তু তাঁরাও চাষিদের প্রশ্ন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। মাড়্গ্রাম থানার কাশিপুর এলাকার বারমল্লিকাপুর গ্রামে সভা করছিলেন তৃণমূলের জেলা নেতা রাণা সিংহ। বক্তব্যর মাঝখানে তিনিও সভাস্থলে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “আচ্ছা বলুন তো, আজকে আপনাদের এলাকায় বোরো চাষে সেচের জলের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, না হয় নি? লোডশেডিং কি আগের মতো হয়?” মঞ্চের সামনে থেকে অনেকেই বললেন, “না। তবে আমাদের এলাকায় লো-ভোল্টেজের সমস্যা রয়েই গিয়েছে। ধানের জমি জলের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। এর কি সমাধান হবে?” রাণাবাবু আশ্বাস দেন, “ট্রান্সফরমার খারাপ। নতুন তার লাগাতে হবে। এই সব ছোট খাটো সমস্যা বাদ দিয়ে আড়াই বছরেরই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে।” সামনে বসে থাকা চাষির মন গলল না। তিনি তো কবে লো-ভোল্টেজের সমস্যা মিটবে তা জানতে চেয়েছিলেন। নেতারা তো সে জবাব দিলেন না। ভোল্টেজ সমস্যায় জমির ধান শুকিয়ে যাচ্ছে তার কি হবে? এই প্রশ্নই দিনরাত ঘুরপাক করছে জেলার বোরো চাষিদের মধ্যে। তাই অন্য কথায় তাঁদের মন নেই।

এই সমস্যায় ভুগছেন বিশেষত নলহাটি থানার লোহাপুর, জেষ্টা, গোঁসাইপুর, খলিলপুর, শালিশন্ডা, কুমার শন্ডা, বারা, কুরুমগ্রাম, বড়লা, গোপালচক, ভদ্রপুর, ধরমপুর, বুজুং ইত্যাদি গ্রামের চাষিরা। তবে এই সমস্যার জন্য রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির একটি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, বোরোচাষিদের একাংশ অবৈধ ভাবে বিদ্যুৎ টানায় ওই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আর ভোট-পর্বে ওই চাষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাত-পাঁচ ভাবছেন কর্মীদের একাংশ। দফতরের অন্য একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, নলহাটি, মুরারই, এবং ভদ্রপুর এলাকায় ১৩২ কেভি একটি সাবস্টেশন দরকার। তা হলেই ওই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির বীরভুম জেলার রিজিওন্যাল ম্যনেজার তপনকুমার দে স্বীকার করেছেন, “এই জেলায় সিউড়ি ছাড়া প্রায় সর্বত্র ভোল্টেজের সমস্যা রয়েছে। তবে কার মধ্যে সব থেকে বেশি সমস্যা নলহাটি থানা এলাকায় রয়েছে।” তিনি জানান, চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের জোগানের ঘাটতি রয়েছে বলে এই সমস্যা। তাই বোরো চাষিদের কথা ভেবে এক সঙ্গে সব ফিডারে লাইন চালু না রেখে কেটে কেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। এতে এলাকার বোরো চাষে কিছুটা সুবিধা হবে বলে বিদ্যুৎ দফতরের মত। নেতা থেকে বিদ্যুৎ দফতরের আধিকারিকরা আশ্বাস দিলেও চাষিদের মন তাতে ভিজছে না। নলহাটি থানার টারাহাট গ্রামের কৃষক মহম্মদ সাহাবুদ্দিন প্রায় ২৬ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। তাঁর আক্ষেপ, “আমার বিদ্যুৎ চালিত সাবমার্সিবল পাম্প থাকলে গত এক মাস ধরে এলাকায় লো-ভোল্টেজ চলছে। সাবমার্সিবল চালানো যায় নি। কোনও রকমে একটি বড় পুকুর থেকে জল তুলে ধান বাঁচানো গিয়েছে।” কিন্তু এমন বহু এলাকা রয়েছে, যেখানে জমির আশপাশে বড় পুকুর নেই। থাকলেও হয়তো গরমের জন্য পুকুরে জল নেই। সেই সব এলাকার চাষিরা মাঠের ধান বাঁচাবেন কী ভাবে?

এ দিকে এ বছরে বোরো চাষের মরসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেচের জল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৭ এপ্রিল থেকে সেচের জল দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে যে সব এলাকার চাষিরা আগে সেচের জল পাননি, তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। বোরো ধানের চরম ক্ষতির সম্ভাবনা দেখছেন তাঁরা। জেলা কৃষি দফতর সূত্রে খবর, এ বার সেচের জলের ভরসায় রামপুরহাট মহকুমার ময়ূরেশ্বর ১, ময়ূরেশ্বর ২, রামপুরহাট ১ এবং রামপুরহাট ২ ব্লকে গত বছরের চেয়ে প্রায় ৮০০০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন কৃষকরা।

রামপুরহাট মহকুমা কৃষি আধিকারিক দিবানাথ মজুমদার জানান, গত বছর এই মহকুমায় ২২ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছিল। এ বার ৩০ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। তিনিও বলেন, “এই সময় ধানের ফলন বাড়াতে জমিতে জলের প্রয়োজন। কিন্তু সেচ সেবিত এলাকা ছাড়া এই মহকুমার নলহাটি ১, নলহাটি ২, মুরারই ১, মুরারই ২ এলাকায় লো-ভোল্টেজের জন্য জমিতে চাষের জল দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে ওই সব এলাকায় ধানের উৎপাদন কম হবে।” ময়ূরাক্ষী উত্তর ক্যানালের জেলা সুপারিন্টেডেন্ট ইঞ্জিনিয়র সুজিত কোনার বলেন, “ইতিমধ্যে তিলপাড়া থেকে চতুর্থ পর্যায়ের জল ছাড়া হয়েছে। কিন্তু এ বারে বোরো চাষে দেরি হওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে চার দিনের জন্য শেষ পর্যায়ের সেচের জল ছাড়া হচ্ছে তিলপাড়া ব্যারাজ থেকে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

low voltage boro cultivation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE