কয়েক মাস আগে আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক-ছাত্রী বা সম্প্রতি পানাগড়ে ‘দুর্ঘটনা’য় চন্দননগরে তরুণীর মৃত্যুকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ বার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা ও তার পরে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রশ্নে বিদ্ধ হচ্ছে পুলিশ। যাদবপুরের ছাত্রদের দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে যে দিন কলকাতা হাই হোর্টের তীব্র ভর্ৎসনার মুখে পড়েছে রাজ্য পুলিশ, সেই দিনই মেদিনীপুর মহিলা থানার ওসি এবং পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ‘অত্যাচার’ চালানোর অভিযোগে সরব হল এসইউসি-র ছাত্র সংগঠন ডিএসও। একই অভিযোগ এসএফআইয়ের সদস্য এক ছাত্রীরও। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব পুলিশের দিকেই বল ঠেলে দিয়েছেন।
যাদবপুর-কাণ্ডে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণের দিনেই তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় মন্তব্য করেছেন, “যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে। ব্রাত্যকে (শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু) কেন পুলিশ বাঁচাতে পারল না, তদন্ত করে দেখা দরকার! সরকার দেখুক, কী ব্যবস্থা নেবে।” এসএফআই যত বাড়বে, সিপিএমের কার্য়ালয়ে তত তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিতেও ছাড়েননি দমদমের প্রবীণ সাংসদ। পুলিশকে তোপ দেগেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বুধবার বলেছেন, “পুলিশ আইন জানে না, ন্যায় সংহিতা বা পুরনো সিআরপিসি পড়েনি? গাড়ির দুর্ঘটনা হয়েছে বলে দুঃখপ্রকাশ করা হচ্ছে। যদি ধরেও নিই দুর্ঘটনা, তা হলে গাড়িটাকে পুলিশ নিয়ে যেত যাদবপুর থানায়। চালককে ধরত, মালিককে আইনি নোটিস দিত। আহত ছাত্রের অভিযোগে তারা আমলই দেয়নি।” আহতদের বিরুদ্ধেই যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা নিয়েও সরব হয়েছে সিপিএম।
বিতর্কের মুখে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী তো সরকারের নীতি মেনেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ ডাকেননি। কিন্তু কেন শিক্ষামন্ত্রীর উপরে হামলা হল, তা দেখা দরকার।’’ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন ধারা, কেন দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আদালত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করে যে মন্তব্য করেছে, তা উদ্বেগজনক।’’
শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় যাদবপুরের ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায়ের জখম হওয়ার অভিযোগ সামনে রেখে গত ৩ মার্চ রাজ্য জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএফআই এবং ডিওসও ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সে দিনই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক থেকে আন্দোলনকারীদের থানায় নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হয় বলে অভিযোগ। পুলিশের ‘অত্যাচারে’র সম্মুখীন হওয়া আন্দোলনকারীদের ডিএসও এ দিন তাদের রাজ্য দফতরে এনে সরব হয়েছে। ডিএসও নেত্রী তথা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সুশ্রীতা সোরেনের অভিযোগ, “আমি নাম, পরিচয় লেখার সময়ে ওসি-র নির্দেশে (মেদিনীপুর মহিলা থানা) মোমবাতি এনে গলিত মোম হাতে ঢেলে দেওয়া হয়। পায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়।” ওসি-র বিরুদ্ধে খুনের হুমকি দেওয়া, ক্ষমা চাওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার মতো অভিযোগও তুলেছেন ডিএসও-র ওই নেত্রী। থানাতেই সিসিটিভি-র আওতার বাইরে থাকা একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে ওসি বেল্ট দিয়ে মারধর করেন বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে ডিএসও-র রাজ্য সভাপতি মণিশঙ্কর পট্টনায়কের বক্তব্য, “গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনও সরকার চললে এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে না। হুমকি-প্রথা যে রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত, তা বোঝা যাচ্ছে।’’ মেদিনীপুর কলেজে অঙ্ক অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, এসএফআইয়ের সুচরিতা দাসেরও অভিযোগ, তাঁকে রাতভর থানায় আটকে অত্যাচার করা হয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের অবশ্য পাল্টা দাবি, একটি বামপন্থী দল, তাদের শাখা সংগঠন পুলিশকে বদনাম করার চেষ্টা করছে! জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার বলেন, ‘‘আটক করা ওই পড়ুয়াদের থানাতেই রাখা হয়েছিল। থানায় ওদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। আমি জানি না, কেন ওরা এটা (অভিযোগ) করছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘পড়ুয়াদের সামাজিক অবস্থানের কথা মাথায় রেখেই আমরা সংবেদনশীল ভাবে আইনানুগ যে ব্যবস্থা নেওয়ার, নিয়েছি। একটি বামপন্থী দল বিষয়টি অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশকে বদনাম করার চেষ্টা করছে।’’ পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যা, ওই দিন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করার জন্য রক্তপাত ছাড়াই পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছিল।
এর মধ্যে ফুটেজ-যুদ্ধও বহাল। সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যাচারে’র অভিযোগ তুলে তৃণমূলের আইটি শাখার প্রধান দেবাংশু ভট্টাচার্য শিক্ষামন্ত্রীর ‘গাড়ির তলায় ছাত্র’ পড়ে যাওয়ার ফুটেজ দাবি করেছিলেন। এসএফআইয়ের তরফে এ দিন ঘটনা সংক্রান্ত কিছু ভিডিয়ো ক্লিপ দেখানোর পাশাপাশি বাইরে থেকে কারা সে দিন যাদবপুরে গিয়েছিলেন, তেমন কিছু নামও বলা হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য সৃজন ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘তৃণমূল প্রমাণ করুক, ওই ছবি ভুয়ো!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)