Advertisement
E-Paper

টাকা কামাতে নোংরা মাখা ছাড়া রাস্তা নেই

বাপি ভুঁইয়া, রাজেশ হাজরা, বাবু মাজি, শিবদাসী হাজরার সাফ কথা, ‘‘টাকা কামাতে হলে নোংরা মাখা ছাড়া রাস্তা নেই!’’

সৌরভ দত্ত

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ০৪:২৬
রুজি: শহরের রাস্তায় নালা পরিষ্কারে নেমেছেন ঠিকা কর্মী। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

রুজি: শহরের রাস্তায় নালা পরিষ্কারে নেমেছেন ঠিকা কর্মী। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

অন্তর্বাসটুকু পরে ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালায় নামাই অভ্যাস তাঁদের। অভ্যাস, ম্যানহোলে দাঁড়িয়ে তরিবত করে চা খাওয়া-ও! উপায় কী?

বাপি ভুঁইয়া, রাজেশ হাজরা, বাবু মাজি, শিবদাসী হাজরার সাফ কথা, ‘‘টাকা কামাতে হলে নোংরা মাখা ছাড়া রাস্তা নেই!’’

রাস্তা কিন্তু থাকার কথা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, সংসদে পাশ হওয়া আইন সব-ই রয়েছে। তবু খাস কলকাতায় নিকাশি নালা, সেপ্টিক ট্যাঙ্ক হাত দিয়ে সাফাই করতে হয় বাপিদের। মাস্ক, দস্তানা কিছুই নেই। সকাল ৮টা নাগাদ তাঁরা পৌঁছে যান কাজের জায়গায়। তার পর চলে শহরবাসীর বর্জ্য সাফাইয়ের কাজ।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ট্যাংরার নতুন পাড়ার বাসিন্দা বাপি বলেন, ‘‘নর্দমায় নামার পরে দুর্গন্ধ তো লাগেই। গুটখা মুখে পুরে নিই।’’ নর্দমায় জল কতটা গভীর, তা বোঝার জন্য বাঁশের সাহায্য নেন সাফাইকর্মীরা। আর এক সাফাইকর্মী সঞ্জীবের কথায়, ‘‘গলা সমান জল হলে আমরা নামব না। নইলে হাফপ্যান্ট, গামছা বা ফুটবল খেলার যে প্যান্টগুলো হয়, সহজে ছেঁড়ে না, সেগুলো পরে নেমে পড়ি।’’ দস্তানা, গামবুট, মাস্ক যে থাকার কথা? তপসিয়ায় এক নম্বর গোবরায় ওয়ার্ড অফিসের কাছে নালা সাফাইয়ের কাজে ব্যস্ত কর্মীরা একযোগে বলে উঠলেন, ‘‘ধুস্! ওসব কিছুই নেই।’’

নোংরা জল বিষাক্তও তো বটে! সাফাইকর্মীদের পুনর্বাসনের দাবিতে সরব বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষা বলছে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করায় জটিল রোগের শিকার হন এঁরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ম্যানহোল বা সেপ্টিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। তবে সে কথা ভাবার সময় কোথায়
রাজেশদের? হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘ম্যানহোলের ঢাকনা ১০ মিনিট খুলে রাখার পরে নামি। এই নর্দমাই আমাদের সব। এখানে চা, নাস্তা, পানি, সব খেয়ে নেব।’’

যেমন স্বাস্থ্যপরীক্ষা করান কি না জানতে চাইলে রাজেশ্বর রায়ের জবাব, ‘‘ওসব আমাদের দরকার হয় না।’’ বস্তুত, দুপুরে কাজ থেকে ফিরে বেশিরভাগ সাফাইকর্মীই নোংরা ঘাঁটার অভিজ্ঞতা ভোলার জন্য নেশা করেন। মোমিনপুরের বাসিন্দা ব্রিজেশ বাল্মীকি বলেন, ‘‘এই যা কাজ, নেশা না করলে ঘুম আসবে না।’’ আরেক সাফাইকর্মী গৌতম হরির কথায়, ‘‘নর্দমায় কাজ করার সময় ধারালো কিছু পায়ে লেগে হাত-পা কেটে যায়। তার জন্য ইঞ্জেকশনের টাকাও ঠিকাদার দেয় না। তাই অসুস্থ হলেও সংসারের খরচ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কথা ভেবে ডাক্তারের কাছে কেউ যায় না। ওই পচা জলই অ্যান্টিসেপ্টিক!’’

ছ’বছর আগে সংসদে পাশ হয়েছে ‘প্রহিবিশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারস অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট ২০১৩’। সেই আইন অনুযায়ী, এই পেশার সঙ্গে নিযুক্ত সাফাইকর্মীদের বিভিন্ন প্রকল্পে পুনর্বাসন পাওয়ার কথা। কাউকে এ ধরনের কাজ করানো হচ্ছে কি না, রাজ্য জেলা স্তরে তার নজরদারি থাকার কথা।

অথচ প্রতিদিন শহরের নানা প্রান্তে নর্দমায় ডুব দেওয়া সাফাইকর্মীরা জানান, ‘বাবু’র কাছ থেকে কাজের বরাত পান ঠিকাদার। সেই ঠিকাদার আবার রোজের ভিত্তিতে সাফাইকর্মীদের নিয়োগ করেন। চার ঘণ্টা কাজের জন্য কোনও ঠিকাদার মজুরি দেন ২৩০ টাকা। কেউ ১৮০ টাকা। ‘বাবু’ কে? বাপিদের কথায়, ‘‘উনি কর্পোরেশনের লোক। আমাদের লাইনে বাবুই সব।’’

যদিও কলকাতা পুরসভার নিকাশি বিভাগের মেয়র পারিষদ তারক সিংহ বলেন, ‘‘পুরসভায় এ ভাবে কাজ করানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোনও ঠিকাদার সংস্থাকেও বরাত দেওয়া হয় না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলছি। নিকাশি নালা পরিষ্কারের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্র রয়েছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা নিজেদের স্বার্থে পুরসভার নাম খারাপ করছে।’’

সাফাই কর্মচারীদের জন্য গঠিত জাতীয় কমিশনের সম্পাদক নারায়ণ দাসেরও বক্তব্য, ‘‘পুরসভার কর্মচারী, ঠিকাদার সংস্থার লোক, কাউকেই ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করা যায় না। অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের প্রকল্প রয়েছে। তাই রুজি হারানোর ভয় নেই।’’

কিন্তু সে কথা জানে কে? শোনেই বা কে? পুরসভা বা ব্যক্তিগত বাড়ি বা আবাসনের ক্ষেত্রে ঠিকাদারের কর্মীরা খালি হাতেই বর্জ্য পরিষ্কার করে চলেছেন। সাফাইকর্মীদের খোঁজে বেরিয়ে কথা হয়েছিল ছোটকা রায়ের সঙ্গে। তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘‘আমরা ঠিকাদারের লোক। ঠিকাদার পুরসভার কাছ থেকে বরাত পায়। এর পর
আমরা ২১০ টাকা রোজে লোক
নিয়ে কাজ তুলে দিই।’’ দস্তানা, বুট, মাস্ক দেওয়া হয় না কেন? কথাটা উড়িয়েই দেন ছোটকা, ‘‘ওসব লাগে না। বরং ওগুলো থাকলে কাজে অসুবিধা হয়।’’

পুরসভার তো যন্ত্র রয়েছে। তা হলে নর্দমায় কাজ করতে লোক নামাতে হয় কেন? এক ঠিকাদারের ‘লোক’ রাজকুমার সিংহ বলেন, ‘‘যন্ত্র কি আর আমাদের মতো কাজ করতে পারবে! আমরা পাইপের ভিতর থেকে মাটি বার করে দিই। সে জন্যই তো পুরসভা ঠিকাদারকে কাজের বরাত দেয়।’’ তাঁর অবশ্য দাবি, দস্তানা, বুট, মাস্ক পরেই তাঁর লোকেরা নর্দমায় নামে। হাত-পা কেটে গেলে ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। শিবদাসী, রাজেশ্বরদের অভিজ্ঞতা তা অবশ্য বলে না।

শৌচালয় সাফাই করেই রোজগার করেন শিবদাসী। বলেন, ‘‘পাউডার ছড়িয়ে পায়খানা পরিষ্কার করতে কষ্ট হয়। প্রথমে দু’চার বালতি জল ঢেলে দিতে পারলে ভাল। কিন্তু দু’বালতির বেশি জলও পাওয়া যায় না।’’ তবু ট্যাংরার নতুন পাড়ায় অনেক ঘর থেকেই এই কাজে যান মহিলারা। শৌচালয় সাফ করতে করতে সরস্বতী হাজরা তো বলেই দিয়েছিলেন, ‘‘হাতে-পায়ে যন্ত্রণা হয়। শরীরে
নানা অসুখ। কিন্তু এ কাজ না করলে খাব কী?’’

Scavengers Garbage Collectors
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy