‘অনুপ্রেরণাদায়ক’ তকমাটা সব সময়ে পছন্দ নয় তাঁর। শালিনী সরস্বতী বলছিলেন, ‘‘প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সাফল্য বোঝাতে বার বার খালি অনুপ্রেরণাদায়ক কেন বলা হবে? তাঁরা সবাই তো এভারেস্টে চড়তে বা খেলাধুলোয় যোগ দিতে চান না। কেউ হয়তো শুধুই শিক্ষিকা হতে চান। মানুষ হিসেবে সম্মান ও মৌলিক অধিকারের একটা জীবন কাটানোর অধিকারটুকু ভারতীয় সমাজ এখনও তাঁদের দিতেপেরেছে কি?’’
মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা শ্রোতাদের দিকে ছুড়ে দেন হার না-মানা মেয়ে। তাঁর হাঁটুর নীচের প্রস্থেটিক ডানার জন্য তিনি এখন ‘ব্লেড রানার’ এবং সুবক্তা বলে পরিচিত। বছর ১৩ আগের পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম। সফল কর্পোরেট চাকুরে শালিনী তখন মাতৃত্বের স্বাদ পেতে নিজেকে তৈরি করছিলেন। কিন্তু একটি ব্যাকটিরিয়াঘটিত সংক্রমণের জেরে ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পচন ধরে হাত-পায়ে। পরে দু’টি হাত এবং হাঁটুর নীচে থেকে দু’টি পা-ই বাদ দিতে হয় তাঁর। হারান গর্ভস্থ সন্তানকেও। কয়েক মাসে সম্পূর্ণ বদলে যায় তাঁর জীবন। গ্রাস করে তীব্র অবসাদ, রাগ।
শালিনী জানাচ্ছেন, সেই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়ের ট্র্যাক পর্যন্ত পৌঁছনোর কৃতিত্ব শুধু তাঁর একার নয়। কৃতিত্ব তাঁর পরিবারের, বন্ধুমহলের এবং তাঁর কোচ বি পি আয়াপ্পারও। কারণ, তাঁরা কেউই ব্যক্তি শালিনীর থেকে তাঁর প্রতিবন্ধকতাকে বড় হয়ে উঠতে দেননি কখনও। শালিনী বলেন, ‘‘ওরা কখনও আমায় বলেনি যে, ‘তুমি এটা পারবে না’। বরং কোচ যখন ১০কিলোমিটার দৌড়তে বলেন, অবাকই হয়েছিলাম। আমি তো ফিটনেসটুকু ফেরাতে কোচের কাছে গিয়েছিলাম,ম্যারাথনে দৌড়তে নয়। সেখানে শুরু থেকে ভারতের জার্সি পরে এশিয়ান গেমসে দৌড়নো সত্যিই স্বপ্নের মতো।’’ ২০২২ সালে প্যারা এশিয়ান গেমসে ‘টি৬২’ (হাঁটুর নীচে থেকে দু’টি পা নেই যাঁদের) বিভাগে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন শালিনী।
তবে শালিনী জানেন, এই পাশে থাকা, নিরন্তর উৎসাহ জুগিয়ে চলা, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিটিকে ‘বোঝা’ না ভাবার মনোভাব খুবই বিরল। আর তাই কী ভাবে রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবার আরও একটু সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে, সম্প্রতি শহরের একটি অনুষ্ঠানে সেই প্রসঙ্গ তুলে আনেন শালিনী। তিনি অকপটে বলেন, তাঁর ও পরিবারের আর্থিক সামর্থ্যছিল বলেই তিনি উন্নত মানের প্রস্থেটিক ব্লেড ব্যবহার করতে পারছেন। সেই ব্লেড ব্যবহার করে কী ভাবে হাঁটতে হবে, তার প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিবন্ধকতা আর আর্থিক অক্ষমতা জোড়া ধাক্কা। গরিব ঘরে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মানো শিশুদের লড়াইটা আরও কঠিন। কারণ সে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বার বার বদলে ফেলতেহয় প্রস্থেটিক। এত খরচে নারাজ হয় অধিকাংশ পরিবারই।’’ শালিনীর অভিজ্ঞতা বলছে, কৃত্রিম অঙ্গ দেওয়ার প্রক্রিয়া অনেকটাই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ব্যক্তিগত উদ্যোগের উপরে নির্ভরশীল। সরকারি স্তরে ছোটবেলায় কৃত্রিম বা সহায়ক অঙ্গ দেওয়া এবং তা ব্যবহারের তালিম দেওয়ার পরিকাঠামোর উন্নতির একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করছেন শালিনী।
বেঙ্গালুরুর একটি প্রস্থেটিক নির্মাতা সংস্থায় কর্মরত শালিনী। তাদের ‘হেল্প আ চাইল্ড ওয়াক’ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত তিনি। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা শিশুদের নিখরচায় জীবনভর প্রস্থেটিক অঙ্গ দেওয়া হয় এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
পাশাপাশি, ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ হিসেবে শালিনী বার বার তুলে আনেন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতেরসঙ্গে যুক্ত করার বিষয়টি। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশুদের আলাদা স্কুলের বদলে অন্য শিশুদের সঙ্গে একই স্কুলে ভর্তি করার জোরালো সওয়াল করেন তিনি। তিনি মনে করেন, এক মাত্র তা হলেই অন্য শিশুরাও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। এ ছাড়াও, গণপরিসরে র্যাম্প, সহজে ব্যবহারযোগ্যশৌচালয় তৈরির মতো বিষয়ও উঠে আসেতাঁর কথায়।
দৌড়ের ট্র্যাক তাঁর সামনে খুলে দিয়েছিল নতুন দিগন্ত। প্রতিযোগিতামূলক দৌড়ে ভবিষ্যতে ফিরবেন কিনা, তা ঠিক না করলেও একটা বিষয়ে শালিনী নিশ্চিত। প্রতিবন্ধকতা সংক্রান্ত সচেতনতার প্রচার তিনি চালিয়ে যাবেন জীবনভর। তিনি বলেন, ‘‘দৃষ্টিভঙ্গির আমূল বদল ঘটাতে হবে। দয়া বা সহানুভূতি নয়, মেটাতে হবে অধিকারের দাবি। তবেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাবলম্বী ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনেরদিশা পাবেন।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)