Advertisement
E-Paper

তৃণমূল নেতার তোলাবাজি, শ্যাম গোষ্ঠীর নালিশেও নিষ্ক্রিয় পুলিশ

বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখনও পর্যন্ত কোনও বড় শিল্প আনতে ব্যর্থ রাজ্য সরকার। উল্টে শাসক দলের কিছু স্থানীয় নেতার উপদ্রবে এ বার শিল্প সংস্থার পাততাড়ি গোটানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্ধমানের জামুড়িয়ায় দুই যুব তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে সরাসরি তোলাবাজি এবং অফিসারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে শ্যাম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৩
জামুড়িয়ায় শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানা।

জামুড়িয়ায় শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানা।

বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখনও পর্যন্ত কোনও বড় শিল্প আনতে ব্যর্থ রাজ্য সরকার। উল্টে শাসক দলের কিছু স্থানীয় নেতার উপদ্রবে এ বার শিল্প সংস্থার পাততাড়ি গোটানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বর্ধমানের জামুড়িয়ায় দুই যুব তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে সরাসরি তোলাবাজি এবং অফিসারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে শ্যাম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও তারা বিষয়টি জানিয়েছে। জানানো হয়েছে শিল্পমন্ত্রী এবং শ্রমমন্ত্রীকেও। বড় গোলমালের আশঙ্কায় পদস্থ কর্তাদের রাজ্যের অন্যত্র এবং রাজ্যের বাইরে গোষ্ঠীর অন্য কিছু কারখানায় বদলি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বুধবারই জামুড়িয়া থানায় অলোক দাস ও চঞ্চল চট্টোপাধ্যায় (যুব তৃণমূল নেতার পদবি অবশ্য বন্দ্যোপাধ্যায়) নামে দু’জনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানানো হয়েছিল। তাতে বলা হয়, ওই দু’জন যে শুধু তোলা এবং নানা সুযোগ-সুবিধা দাবি করছেন তা নয়, পদস্থ কর্তাদের হুমকিও দিচ্ছেন। এই অভিযোগকে ‘এফআইআর’ হিসেবে গ্রাহ্য করে মামলা রুজু করার আর্জিও জানানো হয়। যদিও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত পুলিশ সেই আর্জি মানেনি। কাউকে ধরার তো প্রশ্নই আসে না।

২০০৮ সালে নিজেরাই জমি কিনে জামুড়িয়ায় সার্বিক ইস্পাত কারখানা ও নিজস্ব ব্যবহারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল শ্যাম গোষ্ঠী। তিন পর্যায়ে ৯০০০ কোটি টাকারও বেশি লগ্নি হওয়ার কথা সেখানে। প্রথম পর্যায়ে ২০০০ কোটি টাকার মতো লগ্নি করে বছর তিনেক আগে কারখানাটি চালু করা হয়। পুজোর পরে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ পুরোদমে শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু তৃণমূলের কিছু নেতার উৎপাতে অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কারখানা সূত্রের খবর, শ্রমিক নিয়োগ থেকে শুরু করে গাড়ির বরাত, রেল সাইডিংয়ে মাল ওঠানো-নামানো, সবেতেই নাক গলাচ্ছেন শাসক দলের কিছু নেতা। দৈনন্দিন কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তার জেরে কাঁচামাল আনা আটকে যাচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যও সময়ে বের করা যাচ্ছে না। উৎপাদন ইতিমধ্যেই ৫০% কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতি আর কিছু দিন চললে অচিরেই কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাবে।

এ রাজ্যের প্রতি শিল্প মহলের এমনিতেই আস্থার অভাব। তার উপরে দুর্বল অর্থনীতির কারণে বাজার নেই। ফলে নোকিয়া-সিমেন্স, হিন্দ মোটর, শালিমার পেইন্টস একের পর এক সংস্থা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। এ বার তৃণমূলের এক শ্রেণির নেতাদের তোলাবাজির মুখে পড়ে শ্যাম গোষ্ঠীকেও সেই পথে যেতে হতে পারে বলে শিল্পমহলের আশঙ্কা।

কফিনে শেষ পেরেক পড়ে শিল্পগোষ্ঠীটি সংস্থার জমির পাশে জঙ্গলে ঘেরা একটি খাসজমি কেনার চেষ্টা করায়। তার জন্য সরকারি নিয়মকানুন মেনে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছে আবেদনও করেছে তারা। স্থানীয় সূত্রের খবর, অলোকবাবু ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গেরা সেই বিষয়েই ‘মধ্যস্থতা’ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কারখানার কর্মীদের একাংশের মতে, অলোকবাবুরা চাইছেন খাসজমির অর্ধেক পাশের একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানাকে পাইয়ে দিতে। তাই নিয়েই মতান্তর। তাঁদের অভিযোগ, তার পরেই তোলাবাজি ও নানা অছিলায় বাড়তি সুবিধা দেওয়ার দাবি চরমে ওঠে। দূষণের দাবি তুলে রেলের সাইডিং-এ দু’দিন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায়ই আটকে দেওয়া হচ্ছে রাস্তা। কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলা হচ্ছে, যদিও ‘আসল’ কর্মীরা কেউ এমন দাবি তোলেননি।

জেলার রাজনীতিতে অলোকবাবু শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের অনুগামী বলেই পরিচিত। রাতে মলয়বাবু দাবি করেন, “আমাদের দলের কেউ জড়িত নয়। আমাদের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র কোনও যোগ আছে বলেও আমার কাছে খবর নেই।” অলোক দাস ঘটনাস্থলেই ছিলেন না দাবি করে তিনি বলেন, “আমি যেটুকু জানি, কারখানা কর্তৃপক্ষ মাল ওঠানো-নামানোর জন্য একটি যন্ত্র এনেছিল। স্থানীয় গ্রামীণ মানুষ দাবি করেছিলেন, যন্ত্র নয়, তাঁদের দিয়েই ওই কাজ করাতে হবে। ওই ঘটনায় রাজনীতির যোগই নেই।”

অভিযুক্তের সঙ্গে তাঁদের সংগঠনের সম্পর্ক নেই জানিয়েও আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন আবার বলছেন, “যে হেতু আমাদের নাম জড়িয়েছে, তাই আমি বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছি। কারখানা কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পবান্ধব। দাদাগিরি, মস্তানি করে শিল্পের ক্ষতি তিনি চান না। তাই পুলিশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে আমরা আশা করি।” তাঁর আশ্বাস, “বর্ধমান জেলা আইএনটিটিইউসি সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায় ডেপুটি শ্রম কমিশনারকে চিঠি দিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকার ব্যবস্থা করেছেন। শিল্প চালাতে সমস্যা হবে না।”

তৃণমূল সূত্রের খবর, বুধবারই দুর্গাপুরে তাঁর দফতরে দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন প্রভাতবাবু। জামুড়িয়া ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি তাপস চক্রবর্তী ছাড়াও যুব তৃণমূল নেতা অলোক দাস এবং চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির ছিলেন। বৈঠকে থাকা এক নেতার দাবি, আলোচনার শুরুতেই অলোকবাবুরা চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘এরা চোর, চিটিংবাজ। কারখানায় গুন্ডা ঢুকিয়ে হামলা করিয়ে দেব।’ শ্যাম গোষ্ঠীর ভাইস প্রেসিডেন্ট আর কে চক্রবর্তীর অভিযোগ, “আলোক দাস নামে ওই তৃণমূল কর্মী বেশ কিছু দিন ধরেই কারখানায় জুলুম চালাচ্ছিলেন। তিনি বোধহয় কিছু টাকা হাতানোর মতলবে ছিলেন। ওই দিন মিটিং শুরু হওয়ার আগেই অলোক সেখানে ঢুকে পড়ে বলেন, কারখানা কী ভাবে চালান আমি দেখে নেব। সবাইকে পুঁতে ফেলব।” পরিস্থিতি দেখে প্রভাতবাবু বৈঠক বাতিল করে দেন। প্রভাতবাবু অবশ্য এ দিন এমন কোনও বৈঠকের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “অন্য কেউ কোনও মিটিং করেছেন কি না জানি না, আমি করিনি।” এই অবস্থায় জামুড়িয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন সংস্থার এজিএম-প্ল্যান্ট এইচ আর সুমিত চক্রবর্তী।


জামুড়িয়া থানায় জমা দেওয়া সংস্থার অভিযোগপত্র।

অলোকবাবু অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, “এর সঙ্গে আমাদের যোগ নেই। সংস্থা আমাদের নামে অভিযোগ করেছে কি না জানি না। দলকে সব জানিয়েছি।”

জামুড়িয়ার এই কারখানাটি ছাড়াও বর্ধমান জেলায় শ্যাম গোষ্ঠীর পাঁচটি কারখানা রয়েছে। অসম, মেঘালয় এবং ওড়িশাতেও রয়েছে কয়েকটি। মোট কর্মীর সংখ্যা ১৫ হাজার। বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে গোষ্ঠীটি। জামুড়িয়াতেই কাজ করেন হাজার তিনেক কর্মী। উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় তারা কারখানা সরিয়ে নিলে রাজ্যেরই ক্ষতি। তা সত্ত্বেও তাদের দায়ের করা অভিযোগ পুলিশ ‘এফআইআর’ হিসেবে নিতে গড়িমসি করছে কেন? অভিযুক্তেরা শাসক দলের নেতা বলেই কি? ঠিক যে কারণে বীরভূমে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল বা মনিরুল ইসলামের নাম অভিযোগ থেকে বাদ গিয়েছে? উত্তর এড়িয়ে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের এডিসিপি (সেন্ট্রাল) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “ওই সংস্থা একটি পিটিশন জমা দিয়েছে। আমরা খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।”

shyam gosthi jamuriya tmc leader
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy