ছোটবেলায় ৬-৭ বছর ছিলাম হাওড়ার শিবপুরে। সেটা যদিও পাড়া, পড়শি জোটার বয়েস নয়। হঠাৎ এক ঝটকায় সব পাল্টে গেল। জাপানি বোমার আতঙ্কে বাবা চলে এলেন বাস্তুগ্রাম নদিয়ার দিগনগরে। এক বছর কাটতে না কাটাতেই মশা আর ম্যালেরিয়ার আক্রমণে সে ডেরাও গোটাতে হল। তা ছাড়া সেখানে বাড়ির ছেলেদের পড়াশোনার জন্য স্কুলও ছিল না।
এ বার বাড়ি কিনে কৃষ্ণনগরে আসা। ধোপাপাড়ায়। রাজার তৈরি সামন্তনগর। বিভিন্ন বৃত্তির মানুষদের নিয়ে গড়ে উঠেছে কলুপাড়া, ছুতোরপাড়া, ধোপাপাড়া, কাঠুরিয়াপাড়া, চাষাপাড়া, পাটনিপাড়া। ১৯৪২-এ দেখলাম গোটা ধোপাপাড়ায় মোটে তিনঘর বাসিন্দা। আমাদের নিয়ে পাড়ায় বামুন বলতে চারঘর। আরও পাঁচমিশেলি নানা জাত। তারাই আমার পড়শি। আমার গড়ে ওঠার বয়সে চোখ, কান, মন তো তারাই খুলে দিয়েছে।
যৌথ পরিবারে বড় হওয়া। জীবনে চিনতে শিখছি কাকে বলে পাড়া, কারাই বা পড়শি। তাকিয়ে দেখি, চারপাশে চাকুরিজীবী দু’পাঁচটা পরিবার, একজন উকিল, ছ’জন মোক্তার। জনাপাঁচেক দোকানদার, কেউ বা কোর্টের সেরেস্তাদার, কেউ কীর্তনীয়া। বাড়িতে রোজ বিকেলে আসে মা-বৌদিদের আলতা পরাবার পিসি, বাটনাবাটুনি মাসি, ঠিকে ঝি, রান্নার বামুনদিদি। এরাই পড়শি। সারা গঞ্জের খবরাখবর এদের পেটে বোঝাই। বাড়ির রুদ্ধ মহিলা মহলে এই মাসি, পিসি, দিদিরাই যেন এক একটা জানালা। তখনই জেনেছিলাম এ সব সাতবাড়ি-চরা গতর খাটানো নারীদের দুটো শ্রেণি— এক বিধবা, আর দুই যাদের ‘ঘরে নেয় না’। আমি ছিলাম ওই দশ-পনেরো জনের সংসারে বাড়ির ছোট ছেলে। তাই সাতখুন মাপ। এই যেমন বাসনমাজার সুন্দরীদিদি। তাকে বললাম একদিন, ‘ও সুন্দরদিদি, একদিন তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?’ শুনে কপাল চাপড়ে বলে, ‘ও আমার কপাল, বাড়ি কোথায় আমার? একখানা এঁদো ঘর। তা যাবা তুমি? সোনা, নিয়ে যাব বৈকী, তবে গিন্নিমার হুকুম হওয়া চাই!’ আমি কী করে জানব যে সুন্দরীদিদির এখনকার চামড়া কোঁচকানো হাড়জিরজিরে শরীরের মধ্যে একখানা বহুভোগ্য অতীত ছিল? বৌদিরা রে রে করে উঠল, ‘খবরদার না।’ তবে মায়ের কোলপোঁছা ছেলে বলে কথা! অনুমতি মিলল। তবে হুকুম, ‘সাবধান, কিচ্ছু খাবে না।’ সুন্দরীদিদি ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে ঘরের তালা খোলে। হরেক জিনিসে থই থই ঘর। একপাশে সরু তক্তাপোশে তেল চিটচিটে ময়লা বিছানা। ঘরে একটা বোঁটকা গন্ধ। তা সবমিলিয়ে এক নতুন জগৎ। দিদি যত্ন করে বটি দিয়ে ফজলি আম কেটে একটা চাকলা হাতে দিয়ে বলে, ‘খাও সোনা, দিদি তোমায় কী পোলাও কালিয়া খাওয়াবে বলো?’ নিষিদ্ধ ফলের উপাদেয় স্বাদ যখন উপভোগ করছি, তখন সুন্দরীদিদি বলল, ‘আমারও বড় ঘর, খাট পালঙ আয়না ছিল গো। ঘরে কত নামকরা মানুষ আসত’, বলেই জিভ কেটে সে কী লজ্জা! তার কথা রেখেছিলাম। গিন্নিমাকে কিচ্ছুটি বলিনি।