Advertisement
E-Paper

কাটা ডান হাতেই জুতোয় ফোঁড় দেন বৃদ্ধ ফুলেশ্বর

ডান হাতের কনুইয়ের একটু নীচ থেকেই বাকি অংশটা নেই। সেই অর্ধেক হাতের সামনে, একটা কাপড় ব্যান্ডেজের মতো শক্ত করে বাঁধা। তাতে আটকানো একটা বড় ছুঁচ। ছুঁচের ধারালো মাথায় ছোট্ট নীল প্লাস্টিকের ঢাকনা লাগানো। কাজের সময় ঢাকনা খুলে ফেলছেন বৃদ্ধ। বাঁ হাতে ধরা সুতো।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:১৫
লড়াই: ফুলেশ্বর রাম। —নিজস্ব চিত্র।

লড়াই: ফুলেশ্বর রাম। —নিজস্ব চিত্র।

কয়েকটা বাঁশ দাঁড় করিয়ে ত্রিপলে ছাওয়া কাঠামো। উঁকি মারছে উনুন, কয়েকটা থালা-বাটি। সামনের দিকে খোলা, ফালি জায়গা। ছোট-বড় জুতো, চপ্পল, ব্যাগের পাহাড়। সেই পাহাড়ের কোলে বসে রয়েছেন বৃদ্ধ।

ডান হাতের কনুইয়ের একটু নীচ থেকেই বাকি অংশটা নেই। সেই অর্ধেক হাতের সামনে, একটা কাপড় ব্যান্ডেজের মতো শক্ত করে বাঁধা। তাতে আটকানো একটা বড় ছুঁচ। ছুঁচের ধারালো মাথায় ছোট্ট নীল প্লাস্টিকের ঢাকনা লাগানো। কাজের সময় ঢাকনা খুলে ফেলছেন বৃদ্ধ। বাঁ হাতে ধরা সুতো। সেলাই পড়ছে নিখুঁত। জুড়ে যাচ্ছে একের পর এক ছেঁড়া জুতো। ওই অর্ধেক হাতে আটকানো ছুঁচই তখন অস্ত্র। উপার্জনের অস্ত্র, সমস্ত প্রতিকূলতাকে হারিয়ে দেওয়ার অস্ত্র।

‘‘আমি জানতাম, এ শহরে ফিরতে পারলে পেট চালিয়ে নেব,’’ ২৭ বছর আগে যে প্রত্যয়ে এই সিদ্ধান্ত নেন, সে প্রত্যয় আজও স্পষ্ট ফুলেশ্বরের ঘোলাটে চোখে।

ফুলেশ্বর রাম, বয়স ৬৫ বছর। পেশায় মুচি। আদতে বিহারের সমস্তিপুরের বাসিন্দা। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে, কিশোর বয়সে বাবার হাত ধরে এসেছিলেন মহানগরে। ফুল বিক্রি করতেন। পরে শেখেন জুতো মেরামতির কাজ। বেলগাছিয়ার মিল্ক কলোনি এলাকায় চট পেতে বসতে শুরু করেন।

ঝড় এল ১৯৯০ সালে। সে বছরের শীতে দেশে ফিরেছিলেন প্রতি বারের মতোই। বাড়িতে স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে। চলছিল ধান ঝাড়াই-বাছাই। খড় থেকে বিচালি তৈরির কাজ করছিলেন ফুলেশ্বর। যন্ত্রের ব্লেড ঘুরছে বনবন করে, কুচি কুচি হয়ে যাচ্ছে খড়, তার মধ্যেই ঢুকে গেল ডান হাত। ‘‘আমার চারটে আঙুলও খড়ের মতোই কুচি কুচি হয়ে গেল।’’

গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে রক্ত বন্ধ করে সে যাত্রা প্রাণ বাঁচানো গেল। কিন্তু বিষিয়ে গেল ক্ষত। দিন পনেরোর মাথায় কনুইয়ের খানিকটা নীচ থেকে বাদ গেল হাত।

‘‘তিন মাস ঘরে শুয়ে ছিলাম। তখনই ঠিক করি, কলকাতায় ফিরতেই হবে আমায়।’’ ছুঁচের ফোঁড়ের সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকে ফুলেশ্বরের জীবনের গল্প।

বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন। ভেবেছিলেন, একটু একটু করে সব শিখিয়ে দেবেন ছেলেকে। ‘‘কিন্তু ইস্কুলে পড়া ছেলে কেনই বা মুচির কাজ করবে বলুন, ও ফিরে গেল দেশে। আমি একাই রয়ে গেলাম।’’ আক্ষেপ নেই বৃদ্ধের স্বরে। স্থানীয় বাসিন্দারা সাহায্য করলেন। একটু একটু করে বাঁশ-ত্রিপল দিয়ে তৈরি হল মাথা গোঁজার আস্তানা। নকল হাতেরও ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সেই ভারী কাঠের হাত শুধু পঙ্গুত্বকেই ঢাকে, কাজের সুবিধা করে না তেমন। ফুলেশ্বর বলেন, ‘‘বাঁ হাতটা বেশ সড়গড় তত দিনে। নিজের সব কাজ করে নিতে পারি। শুধু মনে হয়, ডান হাতে ছুঁচটা ধরতে পারলেই...।’’

এক দিন কাটা হাতের সামনে ছুঁচের পেছন দিকটা চেপে ধরে, কষে বাঁধলেন কাপড় দিয়ে। হাতটাই হয়ে গেল ছুঁচ। ‘‘প্রথমে জোর পেতাম না। মনের মতো করে ফোঁড় পড়ত না। শক্ত জুতোয় খুব অসুবিধা হতো।’’ আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে গেল। বিভিন্ন মাপের ছুঁচ আছে, প্রয়োজন মতো ব্যান্ডেজের সঙ্গে আটকে নেন।

লড়াইটা অবশ্য জেতা যেত না স্থানীয়দের সাহায্য ছাড়া। ফুলেশ্বরের আস্তানা-ঘেঁষা বেলগাছিয়া ভিলা আবাসনের বাসিন্দা বিমোচন ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘এলাকার সবাই ওঁর কাছেই সারাতে দিই চটি-জুতো। এত বড় একটা দুর্ঘটনার পরেও কখনও কারও কাছে হাত পাতেননি উনি।’’

ফুলেশ্বর স্বীকার করেন, একটা দুর্ঘটনা শারীরিক ক্ষতি যেমন করেছে, আনন্দও দিয়েছে। ‘‘এমনটা না হলে এত মানুষের ভালবাসা পেতাম না।’’ তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট বৃদ্ধের গলায়।
এখন শুধু চান, একটা পাকা দোকানঘর। সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে এলাকায়, ভাঙা হচ্ছে অস্থায়ী বহু দোকান। এটাই একটু চিন্তার কারণ। ফুলেশ্বরের আর্তি পৌঁছেছে স্থানীয় কাউন্সিলর শান্তনু সেনের কাছে। তিনি বলেছেন, ‘‘এ ভাবে লড়াই করে যিনি বেঁচে আছেন, তাঁর পাশে সব সময় আছি। দরকারে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ফুলেশ্বরের পাকা দোকান তৈরি করিয়ে দেব।’’

ফুলেশ্বর রাম cobbler Specially abled
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy