ডাক্তারের কাছে ফোন এল। ওয়টস্যাপ কল। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের এক কর্তার। খবর কী, প্র্যাক্টিস কেমন চলছে— জাতীয় দু’-একটা মামুলি কথার পর এল আসল প্রসঙ্গ। ‘‘আপনার নামে তো অনেক অভিযোগ। এর পর বাঁচাব কী করে বলুন তো! নিজের ভাল চান তো এসে দেখা করুন।’’ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘মেডিক্যাল কাউন্সিল যদি ডাকে, তা হলে চিঠি দিয়ে ডাকুক। এ ভাবে কেন?’’ উত্তরে আরও চমক, ‘‘ঠিক আছে, আপনি তা হলে নিয়মকানুন নিয়েই ভাবুন। বাকিটা আমরা বুঝে নিচ্ছি।’’
সেই ‘বুঝে নেওয়া’টা কী? অভিযোগ, ছোট-বড় নানা বিষয়ের সূত্র ধরে কাউন্সিলে ডেকে ঠায় বসিয়ে রেখে আনুগত্য দাবি করা হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন বাতিলের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি, কাউন্সিলের নাম ব্যবহার করে টাকা চাওয়ার অভিযোগও উঠছে। দিয়ে দিলে সাময়িক ভাবে সব চুপচাপ। না দিলে নানা বাহানায় হেনস্থা। রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়ার হুমকি। এমন কথাও শোনা যায়, রোগীর বাড়ির লোককে চাপ দিয়ে কোনও কোনও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যন্ত লেখানো হয়েছে। পরে সেই অভিযোগ বাড়ির লোকজন প্রত্যাহারও করেছেন। জানিয়েছেন, চাপ দিয়ে তাঁদের লিখতে বাধ্য করা হয়েছে। এই সব ঘটনায় কাউন্সিলের মুখ পুড়ছে, কিন্তু কর্তাদের কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে অনেকেই বলাবলি করেন, হুমকি প্রথার নতুন আঙ্গিক তৈরি করছে মেডিক্যাল কাউন্সিল। এক কর্তার কথায়, “যেন তেন কাউন্সিলে ক্ষমতা দখল করে থাকাটাই এই মুহূর্তে বড় লক্ষ্য। কাউন্সিলে থাকতে পারলে সব হাতে থাকবে! এদের হাত এত লম্বা যে সব জেনেও কিছু করতে পারি না।”
কাউন্সিলের সভাপতি সুদীপ্ত রায়, সহ সভাপতি সুশান্ত রায়-সহ একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে একাধিক অভিযোগ প্রশাসনের কাছে জমা পড়েছে। কিন্তু তাতে কী! একটা তদন্ত পর্যন্ত শুরু হয়নি। সুশান্ত বলেছেন, ‘‘সবটাই মিথ্যা। কে কী বলল তাতে কী যায় আসে!’’ আর সুদীপ্ত রায় প্রশ্নের বিষয় জানার পরে মুখে পুরোপুরি কুলুপ এঁটেছেন। ফোন, মেসেজ কোনও কিছুতেই তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য দফতরে খোঁজ নিলে অবশ্য জানা যায় এক নতুন সমীকরণের কথাও। দফতরের এক কর্তার অভিযোগ, “কাউন্সিলের দুই কর্তার নিজেদের মধ্যে বনিবনা নেই। তাই দু’পক্ষের অনুগামীদলও আলাদা। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে চাপে রাখার কোনও চেষ্টা বাকি রাখছে না।” কাউন্সিলের এক প্রাক্তন কর্তার কথায়, ‘‘এঁদের তো আলাদা করে বিরোধী পক্ষ দরকার হয় না। নিজেরাই খেয়োখেয়ি করছেন। এই লড়াইয়ে বলি হচ্ছেন এমন কিছু চিকিৎসক যাঁরা শুধু কাজটাই মন দিয়ে করতে চেয়েছেন বরাবর। ‘কোনও একটা পক্ষ বেছে নাও, নয়তো ভোগো’- এই শাসানিতেই তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন ক্রমশ।’’
আর একটা বড় সমস্যার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রবীণ চিকিৎসকেরা। তাঁদের বক্তব্য, এ ভাবে কাউন্সিলের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকলে আদতে ক্ষতি সাধারণ মানুষের। কোনও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ থাকলে সেটার তদন্তও যথাযথ হবে কি না সেই সংশয় ক্রমশ আরও প্রবল হচ্ছে। চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘মেডিক্যাল কাউন্সিল এখন ক্ষমতার নতুন ভরকেন্দ্র। নানা ভাবে ডাক্তারদের চাপে রাখার কৌশল তৈরি হচ্ছে এখানে।’’ গ্রিভান্স রিড্রেসাল কমিটির চেয়ারম্যান, চিকিৎসক সৌরভ দত্তের কথায়, ‘‘কাউন্সিল স্বশাসিত সংস্থা। কিন্তু সকলেরই এটা মনে রাখা উচিত যে কেউই সংবিধানের ঊর্ধ্বে নন। কাউন্সিলকে যদি কেউ নোংরা উদ্দেশে ব্যবহারের চেষ্টা করেন, তা হলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না।’’
কিন্তু প্রতিকারই বা হচ্ছে কোথায়? যে অভীক দে-র বিরুদ্ধে হুমকি প্রথা চালানোর অভিযোগ উঠেছে বারবার, এই মুহূর্তে যিনি সাসপেনশনে আছেন, কাউন্সিলের নানাবিধ অনিয়মে নাম জড়াচ্ছে তাঁরও। নানা কীর্তি সামনে আসার পরেও কাউন্সিলে অভীকের অবাধ যাতায়াত। বৈঠকে সদর্প উপস্থিতি। নেপথ্যে থেকে অভীক এখনও নানা ধরনের ‘অপারেশন’ চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ। সবাই সব দেখেও চুপ? কাউন্সিল কর্তারা জবাব দেননি। অভীক ফোন ধরেননি। উত্তর দেননি মেসেজেরও।
শুধু কি অভীক? স্বাস্থ্য ভবনে ইদানিং ঘনঘন দেখা যাচ্ছে হুমকি প্রথার আর এক মাথা বলে পরিচিত বিরূপাক্ষ বিশ্বাসকেও। সাসপেনশনে থাকা বিরূপাক্ষর কার সঙ্গে, কী এত কথা থাকে? এত মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কেন অভীক-বিরূপাক্ষর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয় না? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা ইন্দ্রজিৎ সাহা কিছু জানাতে পারেননি। তাঁর উত্তর, ‘‘আমি তো খুব বেশি দিন আসিনি। খোঁজ নেব।’’ কী বলছেন বিরূপাক্ষ? তাঁর জবাব, ‘‘স্বাস্থ্য ভবনে যাই এটা জানার জন্য যে আর কত দিন সাসপেনশনে থাকব? সব কিছুরই তো একটা শেষ থাকবে। আমি আর কাকে কীই বা হুমকি দেব?’’
পরিস্থিতি দেখিয়ে দিচ্ছে, যে ভাবে হুমকি প্রথার বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো যায়নি, সে ভাবে বাকি কোনও কিছুই বদলায়নি স্বাস্থ্যে। হাসপাতালে ওষুধের সরবরাহ নিয়মিত হয়নি। ওষুধের নিম্নমান বদলায়নি। যুক্তিহীন রোগী রেফার বন্ধ হয়নি। রোগীর পরিবারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বন্ধ হয়নি। নানা টালবাহানায় চিকিৎসায় বিলম্ব বন্ধ হয়নি। দালালরাজ বন্ধ হয়নি। স্বাস্থ্য দফতরের এক প্রাক্তন আমলার কথায়, ‘‘বন্ধ হয়েছে একটাই বিষয়। মানুষের আশা। পরিস্থিতি বদলাবে, এই আশাটুকুও আর বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে?’’
(শেষ )
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)