Advertisement
E-Paper

ম + ম = ম সমীকরণের সঙ্গেই গ্রাম দিয়ে শহর, পরিষেবা দিয়ে রাজ্য ঘিরছেন মমতা, ভোটের লক্ষ্যে বুথে-বুথেও যাবে নবান্ন

২১ জুলাইয়ের সমাবেশে ভিড়ের বিন্যাস দেখে ভোটের আগে আশ্বস্ত তৃণমূল। যে কোনও বড় জমায়েতেই সাংগঠনিক শক্তি মেপে নেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে। সোমবার সেই শক্তি প্রদর্শনের পর তার রেশ কাটার আগেই মঙ্গলবার সরকারি কর্মসূচি ঘোষণা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫৭

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

মহিলা এবং মুসলিম ভোট মিলে মমতা। অর্থাৎ, ম + ম = ম। মূলত এই সমীকরণের উপর ভিত্তি করেই তিনটি বিধানসভা ভোটে সাফল্য লাভ করেছে তৃণমূল। কিন্তু একই সঙ্গে আগামী বিধানসভা ভোটে তারা যাবে ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সঙ্গে নিয়েও। সেই কারণেই বাড়তি প্রস্তুতি নিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পুরনো সমীকরণের সঙ্গেই তিনি জুড়ে দিচ্ছেন পরিষেবা দিয়ে রাজ্য ঘেরার পরিকল্পনা।

সোমবার ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে দলের জন্য বিধানসভা ভোটের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা। ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার সেই ভোটের লক্ষ্যে সরকারি কর্মসূচিও ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কর্মসূচির পোশাকি নাম ‘আমার পাড়া, আমার সমাধান’। যার আসল উদ্দেশ্য সরকারের পরিষেবাকে বুথ স্তরে নিয়ে যাওয়া। যা বাস্তবায়িত করতে সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে পাড়ায় পাড়ায় নামবে শাসক তৃণমূলের সংগঠনও।

তৃণমূলের বার্ষিক শহিদ সমাবেশের ভিড়ের বিন্যাসে দেখা গিয়েছে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলেছে শাসকদল। জমায়েতে প্রধানত গ্রামের গরিব মানুষ, বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলিম এবং মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ, যারা মমতার জনসমর্থনের মূল ভিত্তি। যা দেখে ‘আশ্বস্ত’ তৃণমূল। যে কোনও রাজনৈতিক দলের বড় জমায়েতেই সাংগঠনিক শক্তি মেপে নেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে। সোমবার সেই শক্তি প্রদর্শন এবং তার নিরূপণের পর মঙ্গলবারেই সরকারি কর্মসূচি ঘোষণা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যা থেকে এই বার্তা স্পষ্ট যে, ২০২৬ সালের ভোট জেতার লক্ষ্যে সরকার এবং সংগঠনকে সমান্তরাল ভাবে মাঠে নামাতে চলেছেন নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা।

ভিড়ের ভাষা

২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে আরও একটি ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন মমতা। তবে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা পড়তে চেয়েছিলেন ‘ভিড়ের ভাষা’। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে ওই ভিড়কে বিধানসভার আধারে ফেলে দেখতে চেয়েছিল শাসকদল। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে দেখা গিয়েছিল, শহরাঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায় বিজেপি ভাল ফল করলেও গ্রামে একচেটিয়া সমর্থন পেয়েছে তৃণমূল। মুসলিম এবং মহিলা ভোট যে মমতার সঙ্গেই রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট করেছিল লোকসভা নির্বাচন। সোমবারের সভায় ভিড়ের বিন্যাস দেখে তৃণমূল মনে করছে, ভোটের বিন্যাসও বদলাবে না। এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘বাংলায় ২৯৪টি বিধানসভার মধ্যে ১৭৪টি কেন্দ্র পুরোপুরি গ্রামীণ এলাকায়। আরও কিছু কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে গ্রাম-মফস্‌সলের মিশেল রয়েছে। আবার মোট বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে কমবেশি ১০০টি কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোট নিয়ন্ত্রক। ফলে বিজেপি যতই মেরুকরণের চেষ্টা করুক, ওরা সফল হবে না।’’

নতুন কর্মসূচি

মঙ্গলবার নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ঘোষণা করেছেন, ‘আমার পাড়া, আমার সমাধান’ কর্মসূচি হবে বুথভিত্তিক। তিনটি বুথ নিয়ে একটি পাড়া। প্রতিটি বুথের জন্য বরাদ্দ ১০ লক্ষ টাকা। একেবারে বুথ স্তরে গিয়ে এলাকার মানুষের সমস্যার কথা শুনবেন সরকারি আধিকারিকেরা। তার পরে সেখানে সমস্যার সমাধান করা হবে। রাজ্যে মোট ৮০ হাজার বুথ। সেই অঙ্কে এই কর্মসূচিতে রাজ্যের কোষাগার থেকে খরচ হবে ৮০ হাজার কোটি টাকা। একটি বুথে স্বল্পদৈর্ঘ্যের রাস্তা নির্মাণ, পানীয় জলের কল, গ্রামাঞ্চলে ছোটখাটো সেতুর মেরামতি, স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো ছোট ছোট দাবি থাকে। সরকার সেগুলিই পূরণ করতে চাইছে।

কেন বুথমুখী নবান্ন?

তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, দলীয় স্তরেই এই কর্মসূচির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নেপথ্যে রয়েছে পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকও। সরকারের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হবে। শাসকদলের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘একই দল টানা তিন মেয়াদ সরকার চালালে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। বিরোধীরা যে তাকে কাজে লাগাতে চাইবে, তা-ও স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে সরকার যদি পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে যায়, তা হলে স্থানীয় স্তরের ক্ষোভও প্রশমিত হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।’’ পাশাপাশিই এক সরকারি আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘যে কোনও সরকারি কর্মসূচির নেপথ্যেই রাজনৈতিক ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রেও আছে। সাধারণ ভাবে মানুষের ধারণা থাকে, সমস্যা হলে তাঁদের প্রশাসনের কাছে ছুটে আসতে হবে। এ বার তাঁরা দেখবেন, পাড়ার সমস্যার সমাধানে সরকারই পৌঁছে যাচ্ছে তাঁদের কাছে।’’

হিন্দু মেরুকরণের পাল্টা

বিজেপি ধারাবাহিক ভাবে হিন্দু ভোট একজোট করার ডাক দিচ্ছে। তা আটকাতে পাল্টা কৌশল নিতে চাইছে তৃণমূল। মুসলিম এবং মহিলা সমর্থনের পুঁজি সংহত রেখেই মমতার সরকার চাইছে উন্নয়নের অস্ত্র দিয়ে হিন্দু মেরুকরণকে ভোঁতা করতে। উল্লেখ্য, দিঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পরে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মমতা ঘোষণা করেছেন, এর পর তিনি একটি ‘দুর্গা অঙ্গন’ তৈরি করবেন। যার নেপথ্যে অনেকেই হিন্দু ভোট টানার কৌশল দেখেছিলেন। তবে তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, এগুলির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বুথ স্তরে উন্নয়ন পৌঁছোলে ছবিটা অন্য রকম হবে। উদাহরণ দিয়ে তাঁদের ব্যাখ্যা, ধরা যাক একটা বুথের ২০০টি পরিবার থেকে সাধারণ মানুষ সরকারি প্রতিনিধিদের জানালেন তাঁদের পাড়ায় কী সমস্যা। স্থানীয় স্তরে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা অভিন্ন হয়। একটি বুথে যদি পাঁচটিও ছোটখাটো সমস্যা চিহ্নিত হয় এবং ভোটের আগে তার সমাধান হয়, তবে মানুষের চোখের সামনে সরকারের টাটকা কাজ থাকবে। তার ফলে মেরুকরণ, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা— দু’টিকেই প্রতিহত করা যাবে।

বুথের ফাঁক ভরাট

উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহল-সহ শহর এলাকার অনেক বুথে তৃণমূল গত লোকসভা ভোটে পিছিয়ে আছে। শাসকদলের নেতাদের আশা, পিছিয়ে থাকা বুথ এলাকায় সংগঠনের মাধ্যমে মানুষকে জড়ো করে সরকারি আধিকারিকদের সামনে সমস্যা জানানো এবং তার সমাধান করা গেলে সেই ফাঁক মেরামত করা সম্ভব। অর্থাৎ, পুরসভা এবং পঞ্চায়েতে জনপ্রতিনিধিদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনই যেখানে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি নেই বা ভোটের নিরিখে পিছিয়ে থাকা বুথ রয়েছে, সেখানে সংগঠনকেও নামাতে চলেছে তৃণমূল।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পরে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আইপ্যাক। তাদের পরামর্শেই ২০২১ সালের ভোটের আগে ‘দিদিকে বলো’, নেতা-মন্ত্রীদের গ্রামে গিয়ে রাত্রিযাপন-সহ একাধিক কর্মসূচি করে সরকার এবং সংগঠনের কাজকে সমান্তরাল ভাবে চালিত করেছিল তৃণমূল। বিজেপির আগ্রাসী প্রচারের পাল্টা মুখ্যমন্ত্রী এবং জনপ্রতিনিধিদের মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার দর্শন নিয়ে সেই কর্মসূচির নীল নকশা আঁকা হয়েছিল। তার ফলও মিলেছিল। ২০০ পার করার হুঙ্কার দেওয়া বিজেপিকে ৭৭-এ থামিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। সেই ভোটেও বাংলা ও বাঙালির গরিমা ছিল তৃণমূলের প্রচারের ভাষ্যে। পাশাপাশি, সরকার এবং মানুষের সমন্বয়ও ছিল কৌশল। আরও একটি বিধানসভা ভোটের আগে আবার সেই পথেই হাঁটছে তৃণমূল। তৃণমূলের ভাষা আন্দোলনের আখ্যানের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বুথে বুথে পৌঁছোবে নবান্নও।

Mamata Banerjee TMC 21st July TMC Rally
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy