Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হুইলচেয়ারে শিক্ষক! মানবোই না, ‘দেখে নেওয়া হবে’ প্রধান শিক্ষিকাকে

হাঁটতে পারেন না মাস্টারমশাই। তাই তিনি নাকি স্কুলে ঠিকমতো পড়াতেও পারবেন না! এবং হুইলচেয়ারে বসা মাস্টারকে চাকরি দেওয়া হলে ‘দেখে নেওয়া হবে’ প্রধান শিক্ষিকাকে।

মায়ের সঙ্গে অর্ণব। — নিজস্ব চিত্র

মায়ের সঙ্গে অর্ণব। — নিজস্ব চিত্র

দিলীপ নস্কর
রায়দিঘি শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩৯
Share: Save:

হাঁটতে পারেন না মাস্টারমশাই। তাই তিনি নাকি স্কুলে ঠিকমতো পড়াতেও পারবেন না! এবং হুইলচেয়ারে বসা মাস্টারকে চাকরি দেওয়া হলে ‘দেখে নেওয়া হবে’ প্রধান শিক্ষিকাকে।

বেমক্কা হুমকি দিচ্ছে একদল লোক। বৃহস্পতিবারের সকাল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘির রায়মণিখাকি স্কুল। নিয়োগপত্র হাতে ওই স্কুলেই নতুন চাকরিতে যোগ দিতে এসেছেন অর্ণব হালদার। তাঁর হুইলচেয়ার ঠেলে সঙ্গে এসেছেন বাবা-মা। সইসাবুদ হবে-হবে, হঠাৎ স্কুলে ঢুকে পড়েছেন ১৫-২০ জন গ্রামবাসী। প্রবল চেঁচামেচি। মোদ্দা কথা— প্রতিবন্ধী মাস্টার চলবে না!

অথচ ‘মাস্টার’ মেধাবী ছাত্র। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ। নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক। টেটও পাস করেছেন। বারবার বোঝাচ্ছেন, তাঁর পড়াতে কোনও অসুবিধে হয় না। কিন্তু শুনছে কে!

ভজহরি হালদার, ভূপাল পুরকাইতদের মতো অভিভাবকেরা বলেই দিলেন, ‘‘উনি এই স্কুলে যোগ দিলে অনেকেই ছেলেমেয়েদের ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে।’’ এই হুজ্জতির মধ্যেই ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকিটা পেলেন প্রধান শিক্ষিকা রেখা কাঁসারি পুরকাইত।

বহু টানাপড়েনের পর, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত এ দিন কাজে যোগ দিতে পেরেছেন অর্ণব। তার আগে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ থেকে একাধিক বার ফোন গিয়েছে প্রধান শিক্ষিকার কাছে। আশপাশের কয়েকটি স্কুলের জনা তিরিশ শিক্ষক-শিক্ষিকাও স্কুলে গিয়ে কথা বলেছেন। সকলেরই বক্তব্য, নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন অর্ণব। তাঁকে কাজে যোগ দিতে না দেওয়াটা অত্যন্ত অন্যায়। তবে দিনের শেষে অর্ণবেরও চিন্তা, তাঁকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে দেওয়া হবে তো?

আমি দৃষ্টিহীন। কিন্তু তা-ও তো ক্লাস নিতে অসুবিধা হয় না। ছাত্রছাত্রীদেরও সমস্যা হয় না। তারক চন্দ্র | শিক্ষক (মধ্যমগ্রাম দোহাড়িয়া বিধানপল্লি হাইস্কুল)

আশ্বাস সকলেই দিচ্ছেন। জেলাশাসক পিবি সালিম বলেছেন, ‘‘ওই শিক্ষককে সব রকম নিরাপত্তা দেওয়া হবে। উনি ওখানেই পড়াবেন।’’ বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়। এ দিন বিক্ষোভের সামনের সারিতেই দেখা গিয়েছে স্থানীয় কিছু তৃণমূল কর্মীকে। যদিও বিক্ষোভে দলের সায় নেই বলে জানিয়েছেন রায়দিঘি ব্লক তৃণমূল সভাপতি অলোক জলদাতা। বলেছেন, ‘‘ওই শিক্ষক যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন, তা দেখা হবে।’’ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য প্রথমে বলেছিলেন, ‘‘ঘটনার রিপোর্ট চাইব।’’ বিকেলের পরে অর্ণব কাজে যোগ দিয়েছেন জেনে তিনি আশ্বাস দেন, ওঁর যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, তা দেখা হবে। এ রকম ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ করা হবে।

তবে আতঙ্ক কাটছে না প্রধান শিক্ষিকার। ওই গ্রামেই থাকেন তিনি। বলছেন, ‘‘যে ভাবে আজ হুমকি দেওয়া হয়েছে আমাকে, তাতে রীতিমতো আতঙ্কে আছি। কী ভাবে প্রতিদিনের কাজ চালাব, জানি না।’’

অর্ণবের বাড়ি ওই স্কুলের কাছেই চাপলা গ্রামে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আক্রান্ত হন রিউমেটয়েড আর্থারাইটিসে। বহু চিকিৎসাতেও রোগ পুরোপুরি সারেনি। ক্রমশ কমতে থাকে হাঁটাচলার ক্ষমতা। ইদানীং দু’টো পা পুরোপুরি অকেজো। বাঁ হাতেও জোর পান না। দুর্বল ডান হাত দিয়ে সব কাজ সারেন। এত কিছুর মধ্যেও পড়াশোনায় ভাল ফল করেছেন বরাবর। মিতভাষী যুবকটি এ দিন বলেন, ‘‘আমি বিক্ষোভকারীদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, আমাকে একটা দিন অন্তত সুযোগ দেওয়া হোক। আমার কাছে ল্যাপটপ আছে। কথা বলতে অসুবিধে হয় না। আমি পড়াতে ভালবাসি। ছেলেমেয়েদের কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা আমার কোনও কথাই কানে তুলছিলেন না।’’

অর্ণবের বাবা আশিস হালদারও শিক্ষক। স্ত্রী রীতাদেবীকে নিয়ে অনেক আশা করে এসেছিলেন ছেলের প্রথম চাকরির জায়গায়। গণ্ডগোল যখন চলছে, সেই সময়ে প্রধান শিক্ষিকা এক বার উঠে যান এসআই অফিসে। স্কুলেই তখন অপেক্ষা করছিলেন অর্ণবরা। পরে ঝামেলা মিটলে সইসাবুদ হয় চাকরির কাগজপত্রে।

আরও পড়ুন:

গরাদ সরিয়ে মায়ের পাশে বসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেই কথা বলতে পারবে শিশুরা

জনা ষাটেক পড়ুয়া আছে স্কুলে। দু’জন মাত্র শিক্ষক-শিক্ষিকা। আরও দু’জন শিক্ষকের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে উপরমহলে সুপারিশ করছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলের সহ-শিক্ষক মানসকুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘অনেক দিন ধরে চাইছি, নতুন কেউ কাজে যোগ দিন। সকাল থেকেই নতুন শিক্ষককে সাদর অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তার মধ্যে এত কাণ্ড ঘটে গেল।’’ ওই শিক্ষকও বলছেন, ‘‘উনি যখন পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন, নিশ্চয়ই ওঁর পড়ানোর ক্ষমতা আছে।’’

এত অশান্তি সত্ত্বেও এ বার আত্মবিশ্বাসী শোনায় অর্ণবের গলা। বলে ওঠেন, ‘‘একা হাঁটাচলা করতে পারি না তো কী হয়েছে। আমার মগজই আমার হাতিয়ার।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

wheelchair Teacher Disable
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE