সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই দেখা গেল, থানার ভিতরে ঢোকার পথের অর্ধেকটা গ্রিল দিয়ে আটকানো।ভিতরে এক জন মহিলা কনস্টেবল বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে। গ্রিলের বাইরে জনা দশেক অপেক্ষমাণ সাক্ষাৎপ্রার্থীর জমায়েত। সেই ভিড় ঠেলে গ্রিলের ছোট্ট ফাঁক গলে থানার ভিতরে যেতেই দৌড়ে এলেন ‘পাহারা’য় থাকা খাকি চুড়িদার পরা মহিলা পুলিশকর্মী। ধমকের সুরে বললেন, ‘‘গট গট করে থানায় ঢুকছেন যে! কারও অনুমতি নিয়েছেন?’’ উত্তরের অপেক্ষা করলেন না! গলা আরও চড়িয়ে, আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘‘বাইরে যান। দেখছেন না, সবাই দাঁড়িয়ে। সময় হলে ডাকব!’’
নরেন্দ্রপুর থানার বাইরে অপেক্ষমাণ আগন্তুকের ডাক এল প্রায় মিনিট ১৫ দাঁড়িয়েথাকার পরে। ওই মহিলা পুলিশকর্মী গ্রিলের বাইরে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘‘কী হয়েছে? থানায় এসেছেন কেন?’’ মোবাইল হারিয়ে গিয়েছে শুনে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘‘দরখাস্ত এনেছেন?’’ উত্তরে না বলতেই ‘আদেশ’ দিলেন, ‘‘সামান্য মোবাইলের জন্য তাড়াহুড়োর কী আছে?সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখে, সঙ্গে আধার কার্ড নিয়ে তবেই আসবেন। তখন আবার ভিতরে ঢুকে পড়বেন না যেন! এখানে অফিসারেরা থাকেন।’’ যদিও দুপুরের ওই সময়ে থানার ভিতরে এক জন ডিউটি অফিসার এবং সিভিক ভলান্টিয়ার ছাড়া বেশি কাউকে দেখা গেল না। সাদা পোশাকে দু’-এক জন পুলিশকর্মীকে দেখা গেলেও বাইরের অপেক্ষমাণ জনতার সঙ্গে তাঁরা কেউই কথা বলতে আগ্রহী নন। বাইরে রাস্তায় অবশ্য উর্দি পরা দু’-এক জন পুলিশকর্মীকে খোশগল্প করতে দেখা গেল।
শহরতলির বিভিন্ন থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে প্রায়ই হয়রানি জোটে বলে অভিযোগ। এফআইআর বা জিডি (জেনারেল ডায়েরি) না নিয়ে লোকজনকে ফিরিয়ে দেওয়ার মারাত্মক অভিযোগও ওঠে। এমনকি, থানার কর্মীদের দুর্ব্যবহার নিয়েও নালিশ প্রচুর। সে সব যে অমূলক নয়, শহরতলির কয়েকটি থানা ঘুরেই তা টের পাওয়া গেল। থানায় যাওয়া অনেকেরই দাবি, পুলিশ অভিযোগ নেওয়ার আগে সমানে ঘোরাচ্ছে। কেউ কেউ জানালেন, অভিযোগ দায়ের হলেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।
পরের গন্তব্য ছিল, বারুইপুর পুলিশ জেলার সোনারপুর থানা। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাইরে চেয়ার পেতে কয়েক জন বসে। সামনের ঘেরা জায়গায় এক জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে। ফোনে গল্পে ব্যস্ত। বাইরে কারা অপেক্ষা করছেন, কারা যাওয়া-আসা করছেন, তাতে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই। বারকয়েক কথা বলতে চাওয়ায় ফোনের কথা থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী অভিযোগ? বিষয়টি শুনে সামনের চেয়ারে বসে থাকার নিদান দিলেন তিনি। খানিক ক্ষণ পরে উর্দি পরা এক পুলিশকর্মী বেরিয়ে এলেন। নামের নীচে লেখা ‘এএসআই’। একে একে কে, কোথা থেকে, কী অভিযোগ জানাতে এসেছেন শুনে চিৎকার করে বললেন, ‘‘একটা অভিযোগের জন্য দু’জনের বেশি থাকবেন না। বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করুন।’’
শ্বশুরবাড়ি থেকে এক তরুণীকে বার করে দেওয়ার ঘটনার অভিযোগ জানাতে হাসানপুর থেকে এসেছিলেন চার জন। পুলিশের ‘নির্দেশ’ মেনে তরুণী ও তাঁর বাবাকে বসিয়ে বাকিরা থানার সামনের রাস্তায় দাঁড়ালেন। তাঁদের এক জন বললেন, ‘‘বার বার থানায় আসছি। দায়টা যেন শুধু আমাদেরই!’’ বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার পলাশ ঢালি যদিও হয়রানির অভিযোগের কথা জানা নেই বলে দাবি করলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পুলিশ জেলায় কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা রয়েছে। থানায় কেউ ফোন করলে তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, তা কেন্দ্রীয় ভাবে খতিয়ে দেখা হয়। সশরীরে কেউ থানায় উপস্থিত হলেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জানার চেষ্টা হয়, তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে থানা কী করেছে।’’
ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার মহেশতলা ও বজবজ থানাতেও নজরে এসেছে হয়রানির চিত্র। এক দুপুরে দেখা গেল, দু’টি থানাতেই পুলিশকর্মীদের সংখ্যা হাতে গোনা। মহেশতলা থানায় ঢুকে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের ঘর ফাঁকা, কিন্তু দরজা বন্ধ। বাইরে বন্দুকহাতে এক কনস্টেবল। ঘর বন্ধ কেন? কনস্টেবল হেসে বললেন, ‘‘ভিতরে থানার লক-আপ। সতর্ক না হলে হবে!’’ বাকি থানা কার্যত ফাঁকা।
বজবজ থানায় যখন যাওয়া হল, তখন প্রায় বিকেল। গঙ্গা সংলগ্ন থানার দায়িত্বপ্রাপ্তের ঘরের পাহারায় দু’জন বসে। তবে, আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মিলল না। ফোনে ‘রিল’ দেখতে দেখতেই এক জন বললেন, ‘‘এখন হবে না। স্যর ব্যস্ত আছেন।’’ অভিযোগ আছে বলায় ডিউটি অফিসারের ঘর দেখিয়ে দিলেন তিনি। সেখানে যেতে দেখা গেল, আলো বন্ধ করে এক মহিলা কর্মী মাথা নিচু করে বসে রয়েছেন। মোবাইল চুরি হয়েছে শুনে বললেন, ‘‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু তো নয়। পরে আসুন।’’ হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে পুলিশ জেলার সুপার রাহুল গোস্বামীকে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। মেসেজের উত্তর দেননি।
(চলবে)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)