E-Paper

জামা লাগবে না, ছেলেটা ভালয় ভালয় ফিরে আসুক

বাবা থাকেন ‘বিদেশে’। সেখানে প্লাস্টিকের জিনিস ফেরির কাজ করেন। গত বারের পুজোয় ছোট মেয়ে প্রাচীকে প্লাস্টিকের পক্ষীরাজ ঘোড়াটা তিনিই এনে দিয়েছিলেন। খুব প্রিয় সেটা ওর। বিদেশ মানে ভিন্ রাজ্য। প্রাচীর বাবা সুজন সরকার পরিযায়ী শ্রমিক।

উষসী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫০
শমসেরগঞ্জের মহিষাস্থলী গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিক সুজন সরকারের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী শেফালি ও মেয়ে প্রাচী।

শমসেরগঞ্জের মহিষাস্থলী গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিক সুজন সরকারের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী শেফালি ও মেয়ে প্রাচী। ছবি : অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। এই সময় ঘরের পাখাটা বন্ধ রাখলে আরাম হয়। দূরে কোথাও ঢাকিদের মহড়া চলছে, ভেসে আসছে তার আওয়াজ। মনের গহিনে ঘোলাটে দৃশ্যগুলো প্রথমে নীল, ক্রমে সবুজ। ধানখেতের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে ছোট্ট মেয়েটা। সামনে আবছা পাকা বাড়ির ছবি। পক্ষীরাজ ঘোড়াটা বাঁ হাতে শক্ত করে ধরে থমকে দাঁড়াল সে। ভিতরে কেউ দাঁড়িয়ে। বাবা! শান্ত চেহারা, স্থির দৃষ্টি। নাক বেয়ে রক্ত পড়ছে। রোগা শরীর। তাতে নানা ক্ষত। দু’হাত সামনে এগিয়ে ডাকছে মেয়েকে। ঘুমের মধ্যে ডুকরে কেঁদে ওঠে বছর সাতেকের প্রাচী।

দু’মাস ধরে প্রায় রাতেই এমন হয়। মা তড়িঘড়ি উঠে কোলে তুলে নেন, বুকে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

বাবা থাকেন ‘বিদেশে’। সেখানে প্লাস্টিকের জিনিস ফেরির কাজ করেন। গত বারের পুজোয় ছোট মেয়ে প্রাচীকে প্লাস্টিকের পক্ষীরাজ ঘোড়াটা তিনিই এনে দিয়েছিলেন। খুব প্রিয় সেটা ওর। বিদেশ মানে ভিন্ রাজ্য। প্রাচীর বাবা সুজন সরকার পরিযায়ী শ্রমিক। ওড়িশার ঢেনকানলে যান কাজ করতে, গ্রামেরই এক ঠিকাদারের সঙ্গে। কয়েক জন মিলে। ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেনও একসঙ্গে। আর দু’তিন মাসে এক বার মুর্শিদাবাদের মহিশাস্থলীতে দেশের বাড়ি ফেরেন। ক’বছর ধরে এই চলছে। ওড়িশায় থাকতে থাকতে দিব্যি ওড়িয়া বলতেও শিখে নিয়েছেন সুজন।

আগে পাউরুটির ভাটিতে কাজ ছিল। উপার্জন তেমন হয় না বলে বাইরে এই ফেরির কাজটা ধরেছেন। স্বাধীনতা বেশি, পরিশ্রম কম। টাকা মাসে হাজার কুড়ি তো চলেই আসে। প্রতি বারই পুজোর সময় সুজনের পথ চেয়ে অপেক্ষায় দুই মেয়ে, দীপ্তি আর প্রাচী। এক জন নয়, আর এক জন সাত। বাবার কাছে নানা বায়না লেগেই থাকে ওদের। আজ পেন্সিলবাক্স, কাল সাইকেল। এ বার পুজোয় দীপ্তি এক গোছা সবুজ কাচের চুড়ি চেয়েছিল।

কিন্তু এ বারের ফেরাটা ছিল অন্য রকম। ছোট মেয়েটা দিদির পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, খেলনা আনেনি বাবা। দিদি যে চুড়ি চেয়েছিল সেটাও না। মা-ঠাকুমার মুখ কাঁদো কাঁদো। বাবাকে পাড়ার কাকুরা ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে রেখে গিয়েছিল। হাতে, পায়ে, কপালে কালশিটে আর কাটা দাগ। চোখে আতঙ্ক। সেই চেহারা ভুলতে পারে না প্রাচী। কী বুঝেছিল, কে জানে! বাবার কাছে এসে বসত। কখনও ক্ষতে লাগিয়ে দিত মলম। তবে ভয় পেয়ে বসেছে ওকে। স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে বাবার সেই ভয়ধরানো চেহারা।

সুজন এখনও বুঝতে পারেন না, কেন মার খেতে হল তাঁকে? গলায় তুলসীর মালা, সঙ্গে গীতা। কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গিরা যেমন পর্যটকদের ধরে বলেছিল কলমা পড়তে, তেমনই ওরা বলল হনুমান চল্লিশা বলতে। সেটা তো জানা নেই! কোন বাঙালি আর হনুমান চল্লিশা মুখস্থ রাখে! ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ বুলি আওড়েছিলেন সুজন, কিন্তু হল না। ওরা বলল, “লুঙ্গি খোল।” ভরদুপুরে রাস্তার মাঝে লুঙ্গিটা খুলতে বাধ্য করেছিল ওরা। রাস্তায় পড়ে মার খেয়েছিলেন তিনি। ফেরির অনেক টাকার জিনিস ছিল ভ্যানে, পালালে সেগুলিতেও আগুনলাগিয়ে দিত।

সে দিন বেধড়ক মারের মাঝে বার বার নাগরিকত্ব, জাত, ধর্ম প্রমাণের চেষ্টা করেছেন সুজন। শেষে কোনও মতে ভ্যান নিয়ে আস্তানায় ফিরেছেন। দিন তিনেক হাসপাতালে ছিলেন। হাতে মাত্র ক’টা টাকা। যারা মেরেছিল, তাদের পান্ডা নাকি এক প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকের ছেলে। তার নামে পুলিশে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। শেষে নিজের গ্রামে ফিরেছিলেন ক্ষতবিক্ষত সুজন।

সকাল-সন্ধ্যা ছেলেগুলোর পুণ্য কামনায় তুলসীতলায় ধূপ দেখাতেন সুজনের মা শেফালি। ইদানীং প্রার্থনায় পুড়ে যাওয়া কাঠিগুলো বেদিতেই জমে থাকে। দুই ছেলেই মায়ের চোখের মণি। তবে মায়ের চিন্তা বড় সুজনকে নিয়ে। “ভীতু প্রকৃতি, ছোট থেকেই ভোগে। কী হয়ে গেল, বলুন!” মুখে চোখে অস্থিরতা শেফালির। “কত মারিছে আমার ছেলেটারে! ফোনে রোজ বলি, বাবা গীতা সব সময় সঙ্গে রাখবি, গুরুর নাম নিবি। ও ‘জয় শ্রীরাম’ও বলছিল। কিছু শোনে নাই ওরা।”— গলা কাঁপে। চোখ মুছে নেন আঁচলের খুঁটে।

যান্ত্রিক দক্ষতায় বিড়ি পাকিয়ে কুরুশ কাটার পিছনটা দিয়ে মাথা মুড়তে মুড়তে শেফালি বলতে থাকেন, “লোন নিতে হইছিল বেশ কিছু। বড়টা তো বাইরে কাজ করেই সেই টাকা অনেকটা মেটাল।” পাশ থেকে সুজনের স্ত্রী লক্ষ্মী বলেন, “মাল তুলবে। সেজন্যই আবার ‘লোন’ নিছে। দু’টো মেয়ের খরচ আছে। পুজোর সময় হয়তো দু’টা শাড়ি নিই, মা-বাবার হাতেও নতুন কাপড় দেয়। পুজোর আগে কী ঘরে বসা যায়? ‘লোন’ তো বুঝবে না!”

সুজন আবার গিয়েছেন কাজে। এ বারে নাগপুর। ভরসা শুধু এই যে, সঙ্গে আছেন ওঁর শ্বশুর ও শালা। তাঁর কাজ এখন, মাথায় করে বালি-পাথর বয়ে আনা, সিমেন্টের মশলা মাখা, লোহার রড পেটানো। এ সব কাজ করতে কষ্ট হয় সুজনের। তাও, পুজোর আগে কী ঘরে বসা যায়! শেফালি এক বার বলে ওঠেন, “টাকা লাগবে না গো, ছেলেটা আমার ঘরেই থাক।” পর ক্ষণেই বলেন, “কাজে তো যেতেই হবে। ঘর যে চলবে না।”

দাওয়ার সামনে হেলে পড়া আধখানা মাটির দেওয়ালের পাশে পাতা আর কাদা নিয়ে খেলছিল দীপ্তি, প্রাচী। সামনের ডোবায় ক’টা পদ্ম ফুটেছে। তার একটা তাক করে পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুড়ছে এক দল ছেলে। পাড়াটা কেমন থম মেরে আছে। সব বাড়ির ছেলেই তো পড়ে আছে দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে।

পুজোয় কী করবি? লজ্জায় হাসে দীপ্তি। বলে, “বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাব, মেলায় যাব, চুড়ি কিনব।” আর জামা? “জামা লাগবে না।” দাওয়া থেকে শেফালি বলে ওঠেন, “ছেলেটা আমার ভালয় ভালয় ফিরুক, আর কিছু চাই না।”

আর এক বার চোখ মুছে ঘরে যান শেফালি। এগারো জন দেবতাকে ধূপ দেখিয়ে বাইরে এসে কাঠিটা পুঁতে রাখেন তুলসী বেদিতে। শঙ্খে ফুঁ দেন, প্রণাম করেন অনেক ক্ষণ ধরে।

শরতের আকাশ বিষণ্ণ। বুক কাঁপে। আবার বুঝি বৃষ্টি নামবে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Migrant Worker harassment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy