E-Paper

সচেতনতা বাড়লেও ছুতমার্গেই কি থমকে যাচ্ছে কর্কট-যুদ্ধ

স্তনের কর্কট রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি ও উচ্চ মৃত্যুহার জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগের বিষয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, কিন্তু তা হচ্ছে কই?

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৫ ০৮:৪৪
মহিলাদের মধ্যে স্তনের কর্কট রোগই সব চেয়ে বেশি।

মহিলাদের মধ্যে স্তনের কর্কট রোগই সব চেয়ে বেশি। —প্রতীকী চিত্র।

সচেতনতা যে নেই, তেমনটা বলা যাবে না। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ক্রমশ বাড়ছে মৃত্যুর হার। স্তনের কর্কট রোগ নিয়ে এমনই মত চিকিৎসকদের। মহিলাদের মধ্যে স্তনের কর্কট রোগই সব চেয়ে বেশি হয় বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। এ দেশে ২০২৪ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লক্ষ ২৬ হাজার। মৃত্যুর সংখ্যা ৯৮৮০০। অর্থাৎ, এই রোগে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য। বহু প্রচার সত্ত্বেও বাস্তব চিত্রটা এমন কেন?

কর্কট শল্য চিকিৎসক সৈকত গুপ্তের মতে, রোগটি নিয়ে যে সচেতনতার অভাব রয়েছে, তা বলা যায় না। তিনি বলছেন, ‘‘মহিলারা জানেন যে, স্তনে পিণ্ডের মতো কিছু পাওয়া গেলে, তা বিপজ্জনক হতে পারে।’’ কিন্তু সেই সচেতনতার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে রয়ে যাচ্ছে ফাঁক। ওই চিকিৎসক জানাচ্ছেন, স্তনের কর্কট রোগ বাড়ছে, তা জানা সত্ত্বেও প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ চিহ্নিত করতে কী করণীয়, তা জানেন না অনেকেই। সেল্ফ এগজ়ামিনেশন বা নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা ও নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে নিয়মিত ম্যামোগ্রাফি করানোয় গড়িমসি দেখা যায় গ্রাম ও শহরে। এর জেরে রোগ ধরা পড়া এবং চিকিৎসা শুরুতে বিলম্বের জন্য বাড়ে মৃত্যুর আশঙ্কা। তবে শহরাঞ্চলে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়েই চিকিৎসা শুরুর হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায়অনেকটাই বেশি। রোগ নিয়ে ছুতমার্গ ও ভুল ধারণা এবং শহরের বাইরে উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাবও ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যু-হারের কারণ, জানাচ্ছেন সৈকত।

‘‘এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে পরবর্তী পরীক্ষায় অনেকেই ভয় পান। ভাবেন, বায়োপসি করালে রোগ ছড়িয়ে পড়বে। আবার প্রথাগত অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপির পথে না হেঁটে বিকল্প চিকিৎসার শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতাও রয়েছে। তাতে নষ্ট হয় মূল্যবান সময়।’’— বলছেন সৈকত গুপ্ত। ভয়ের বাতাবরণও দেরির একটি কারণ। চিকিৎসকদের মতে, রোগ ধরা পড়লে দিশাহারা হয়ে বহু মানুষ যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন না। অথচ, দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে যে শুধু সুস্থতার হার বাড়ে তা-ই নয়, খরচ এবং রোগীর কষ্টও কমে। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র ওষুধেও এই চিকিৎসা সম্ভব। স্তন বাদ দেওয়ার ঘটনাও কম হয়।

তাই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ চিহ্নিত করার বিকল্প নেই বলে মত সৈকতের। তাঁর মতে, সচেতনতার স্তর থেকে যত দিন না পরবর্তী পদক্ষেপ করার স্তরে সাধারণ মানুষ পৌঁছচ্ছেন, তত দিন প্রচার চালিয়ে যেতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে এই রোগীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে চিকিৎসক অগ্নিমিতা গিরি সরকার জানাচ্ছেন, স্তনের কর্কট রোগ নিয়ে তীব্র সামাজিক ছুতমার্গ রয়েছে, যা অন্যান্য কর্কট রোগের থেকে কয়েক গুণ বেশি। যার জন্য রোগ লুকিয়ে রাখা বা চিকিৎসা শুরু করাতে দেরির প্রবণতা রয়েছে। পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশীরা কী বলবেন, সেই চিন্তায় থাকেন রোগীরা। নারী-স্ত্রী-মা হিসাবে অনেক সময়ে পরিচয়ের সংশয়ে ভুগতে শুরু করেন তাঁরা। কিছু রোগী যেমন নিকটজনের থেকে সহায়তা পান, তেমনই পরিবারের মধ্যেই একঘরে করে দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। কাউকে একসঙ্গে বসে খেতে দেওয়া হয় না, আবার কারও কাছে বাচ্চাকে যেতে দেওয়া হয় না। বৈবাহিক সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কাও থাকে ষোলো আনা। কেমোথেরাপির সময়ে চুল উঠে যাওয়া, চামড়া কালো হওয়া, বমি-ডায়েরিয়া, অ্যানিমিয়ার সঙ্গে যুঝতে গিয়ে অনেকের কার্যত বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে যায়। স্তনে কর্কট রোগ হয়েছে শুনলেই বহু মেয়ে ভাবেন, স্তন বাদ দিতে হবে। অগ্নিমিতা বলছেন, ‘‘এই সময়ে অবসাদ কাটিয়ে ওঠার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন। কেমোথেরাপির প্রভাব যে চিরস্থায়ী নয়, তা বোঝাতে হয়। অঙ্গহানির ভয় কাটাতে হয়। যাঁরা রোগীর পাশে থাকেন, তাঁদেরও আশ্বাসের প্রয়োজন।’’

এই সাহায্যেরই হাত বাড়িয়ে দেয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিতৈষিণী। সংস্থার তরফে কৃষ্ণা দত্ত জানাচ্ছেন, সরকারি স্তরে চিকিৎসা পাওয়ার সুবিধা আগের চেয়ে বাড়লেও চিকিৎসা-পরবর্তী নানা দিক নিয়ে সচেতনতা এখনও কম। নিম্নবিত্ত পরিবারে এই সমস্যা তুলনায় বেশি। পরিবারের আর্থিক বোঝা বাড়বে, এই চিন্তায় মহিলাদের সমস্যা লুকিয়ে রাখা বা বা চিকিৎসা না করাতে চাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আবার, চিকিৎসা চলাকালীন বহু মেয়ের বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনটুকুও মেটে না। কেমোথেরাপি চলাকালীন ভারী কাজ করা বারণ থাকলেও তা মানা হয় না। তাই রোগীর বাড়ির লোকেদের মধ্যেও সচেতনতার প্রচার করেন তাঁরা। ফলোআপ চিকিৎসার গুরুত্ব বোঝানো, মানসিক জোর বাড়ানো, ব্যায়াম ও ম্যাসাজ দেখানো, ওষুধ ও কৃত্রিম স্তনের ব্যবস্থা করতে প্রতি বৃহস্পতিবার, দুপুর ২-৪টে পর্যন্ত তাঁদের স্বেচ্ছাসেবকেরা থাকেন সিএনসিআই হাসপাতালে।

তবে এই পর্যায় আসে চিকিৎসা শুরুর পরে। কিন্তু কী কী লক্ষণ দেখা গেলে যেতে হবে চিকিৎসকের কাছে? কী ভাবেই বা ঠিক চিকিৎসার পথে এগোবেন রোগিণী?

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cancer Breast Cancer

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy