দিনের কোনও এক সময়ে নাম-ঠিকানার তালিকা পৌঁছে যাবে ফোনে। কাজ বলতে সেই তালিকা ধরে ধরে বিভিন্ন ঠিকানায় গিয়ে যত রকম ভাবে সম্ভব বকেয়া থাকা ঋণ আদায় করতে ঋণ গ্রহীতার ব্যক্তিগত সম্মান জনসমক্ষে ভূলুণ্ঠিত করতে হবে। তাতেও কাজ না হলে মারধর, ঘরছাড়া করা, তুলে নিয়ে যাওয়া বা পরিবারের ছেলে-মেয়ের সর্বনাশ করার হুমকি দিতে হবে! বকেয়া ঋণ আদায়ের নামে দেশ জুড়ে এমনই অত্যাচার দিনের পর দিন চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। সেই আদায়কারী দলের চাপে বহু ক্ষেত্রেই ঋণগ্রহীতা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে সাম্প্রতিক নানা পুলিশি তদন্তে। যদিও ব্যাঙ্ককর্মীদের সংগঠনের সদস্যদেরই দাবি, এমন কোনও ঋণ আদায়কারী দল থাকার কথাই নয়। কেউ ঋণখেলাপি হলে ব্যাঙ্কের কাছে আইনের পথে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তা না করে রীতিমতো ‘ভাড়াটে গুন্ডা’র কায়দায় লোক পাঠানো হচ্ছে বাড়ি বাড়ি!
সম্প্রতি ট্যাংরা, বেহালার হো চি মিন সরণি বা কসবার হালতুতে একের পর এক সপরিবার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিক পরিস্থিতির কারণে পরিবারগুলি এমন পথ বেছে নিয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। পুলিশ দেখেছে, প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই ঋণ আদায়কারী দল বা ‘রিকভারি এজেন্ট’রা বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে আসার পরেই ঘটেছে এমন ঘটনা। হালতুতে আড়াই বছরের ছেলেকে মেরে বাবা-মায়ের আত্মহত্যার ঘটনায় পুলিশ এক রিকভারি এজেন্টকে গ্রেফতারও করেছে। যদিও ব্যাঙ্ক পরিষেবার সঙ্গে যুক্তেরা জানাচ্ছেন, শহরের চেয়েও খারাপ চিত্র গ্রামে। বহু কৃষক ফি-বছর বকেয়া ঋণ আদায়কারী দলের চাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। তাঁদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বা ঘরছাড়া করার অভিযোগও সামনে আসছে। এ নিয়ে সংসদেও সরব রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু বছরের পর বছর এ নিয়ে আলোচনা হলেও পরিস্থিতির বদল হচ্ছে না বলে অভিযোগ।
‘অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি তথা ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যাঙ্ক কর্মচারী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক রাজেন নাগর বললেন, ‘‘বাড়িতে ভাড়াটে গুন্ডার মতো লোক পাঠানো আইনবিরুদ্ধ। প্রয়োজনে ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে ব্যাঙ্ক। সে ক্ষেত্রে আইনের পথে এগিয়ে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সম্পত্তি নিলাম করে তখন টাকা আদায় করা যায়। কিন্তু আইনি লড়াই করার বদলে অপেক্ষাকৃত সহজ পথ হিসাবে রিকভারি এজেন্ট পাঠিয়ে কার্যোদ্ধারের পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে।’’ রাজেন জানান, চলতি বছরেই দেশে ১৫ লক্ষ ৬৮ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ মকুব করা হয়েছে। ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে কর্পোরেট ঋণ মকুব করেছে কেন্দ্র। আইনের পথে ঋণ মকুব হয়ে যেতে পারে ভেবেই ব্যাঙ্কগুলি সহজ পথ নিচ্ছে বলে দাবি ওয়াকিবহাল মহলের।
বকেয়া ঋণ আদায়ের কাজে যুক্ত মধ্য কলকাতার এক বাসিন্দা জানান, বাইক ট্যাক্সি চালানোর কাজ করেন তিনি। পাশাপাশি, কয়েকটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলা রয়েছে তাঁর। দিনের কোনও একটি সময়ে নামের তালিকা ও ঠিকানা পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁর ফোনে। মূলত মধ্য কলকাতার ঠিকানাই দেওয়া হয় তাঁকে। সে সব ঠিকানায় গিয়ে যে ভাবে সম্ভব বকেয়া আদায় করতে বলা হয়। তাঁর কথায়, ‘‘এই কাজে মাসিক বেতন নেই। বাইকের জ্বালানির খরচ দেওয়া হয়। বলা থাকে, যে টাকাই আদায় করা যাবে, তার ৫০ শতাংশ ব্যাঙ্কের, বাকি ৫০ শতাংশ এজেন্টের। এক ঝটকায় অনেকটা আয় হতে পারে ভেবে এজেন্টরা যেমন খুশি নির্যাতন শুরু করেন। অপমান করা বা লোক জড়ো করে সম্মানহানি করা অনেক ছোট ব্যাপার। রীতিমতো সর্বনাশ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতে থাকে।’’ ওই এজেন্ট এর পরে নিজেই বলেন, ‘‘ব্যাঙ্ক ঠিকঠাক নথি না দেখেও অনেক সময়ে টাকা দিয়ে দেয়। টাকা ফিরবে না ধরে নিয়েই তখন এজেন্ট লাগানো হয়। মোটা টাকার হাতছানি আছে ভেবে এজেন্টও ভাবেন, লোকটা বাঁচবে কী মরবে, তাতে তাঁর কী!’’
আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এমন সব ঘটনায় রিকভারি এজেন্ট আর ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা হওয়ার কথা। দুঃখের বিষয়, ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না। ফলে মানুষ মরতে থাকেন, পরিস্থিতির বদল হয় না।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)