দু’দিনের অচলাবস্থা কাটল। অবশেষে জট কাটলো ‘বন্দে মাতরম-এসআইআর’ বিতর্কের।
মূলত লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম্’ প্রসঙ্গের উত্থাপন ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে সেই সংক্রান্ত আলোচনার পরে এসআইআর নিয়ে আলোচনার যে প্রস্তাব সরকার দিয়েছিল তাতে সম্মতি জানিয়েছে তৃণমূল। আজ বিকেলে সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহের সোমবার লোকসভায় বেলা ১২টা থেকে বন্দে মাতরম্ গানের দেড়শো বছর পূর্তি এবং মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকে লোকসভায় নির্বাচনী সংস্কার সংক্রান্ত আলোচনা হবে। বিরোধীদের বক্তব্য, ওই বিতর্কেই ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) করতে গিয়ে নির্বাচনী কর্মীদের মৃত্যু, মানুষের হেনস্থার বিষয়ে সরব হবে তারা।
বাদল অধিবেশনে বিরোধীদের এসআইআর নিয়ে আলোচনার দাবি মানেনি নরেন্দ্র মোদী সরকার। এ বার দু’দিনের টানা প্রতিবাদের পরেই সরকারের মেনে নেওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা মণিকম টেগোর বলেন, ‘‘বিরোধীদের চাপের কাছে ঔদ্ধত্য মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে।’’ রাজনীতিকদের মতে, বাদল অধিবেশনের সময়ে বিহারে এসআইআর হলেও, মৃত্যুর মিছিল দেখা যায়নি। এখানে বারোটি রাজ্যে বহু বুথ লেভল অফিসার (বিএলও)-এর মৃত্যু সত্ত্বেও, এ নিয়ে সরকার আলোচনায় নারাজ— এই বার্তা জনমানসে পৌঁছতে শুরু করেছিল। যাতে অস্বস্তি বাড়ছিল সরকারের। তাই বিরোধীদের দাবি মেনে কিছুটা পিছু হটে এসআইআর নিয়ে আলোচনায় রাজি হতে হল মোদীদের। তবে এসআইআর-এর আগে ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়ে আলোচনায় বিরোধীদেররাজি হওয়াকে নৈতিক জয় হিসেবে দেখছে বিজেপি।
শাসক শিবিরের যুক্তি, সরকার গোড়া থেকেই যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার পক্ষে। তাই আজ বেলা ১১টার অধিবেশন বিরোধীদের হট্টগোলে ভেস্তে যেতেই উদ্যোগী হয়ে স্পিকার বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলেন। ঠিক হয়, ১২টার অধিবেশনের পরে সংসদবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবে বিরোধীরা। সেই বৈঠকে কার্যত এসআইআর নিয়ে আলোচনায় রাজি হওয়ার প্রশ্নে প্রথম ইঙ্গিত দেয় সরকার। বৈঠকে ছিলেন তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং কাকলি ঘোষদস্তিদার। বৈঠকে ডেরেকেরা জানান, সব বিষয়ের আগে এসআইআর নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কারণ, দেশ জুড়ে মৃত্যুমিছিল চলছে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে কাকলি বলেন, ‘‘সরকার নীতিগত ভাবে এসআইআর নিয়ে আলোচনায় রাজি হলেও, বন্দেমাতরম্ আগে না এসআইআর আগে— তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’’ ঠিক হয় বেলা ২টোয় বিবৃতি দিয়ে এসআইআর নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ঘোষণা করবে শাসক শিবির। ওই বৈঠকে ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়ে আগে আলোচনার দাবিতে বিজেপির একগুঁয়েমিকে কটাক্ষ করে আপ সাংসদ সঞ্জয় সিংহ বলেন, ‘‘আপনারা তো বাংলার নির্বাচনের কথা ভেবেই বন্দেমাতরম্ নিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন।’’
যদিও বেলা ২টোয় সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি না-আসায় ফের অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায়। রাজ্যসভাতেও ওয়াক আউট করেন তৃণমূল-সহ অন্য বিরোধী সাংসদেরা। মূলত আগে কোন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে, তা নিয়ে জট তখনও রয়ে গিয়েছিল। বিরোধীরা আগামিকাল থেকেই এসআইআর নিয়ে আলোচনা চাইলেও, সরকারের যুক্তি ছিল, ওই আলোচনা সময় সাপেক্ষ। বুধবার শুরু হলে তা গড়াবে শুক্রবারে। অথচ, বৃহস্পতিবার দু’দিনের সফরে ভারতে আসছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রধানমন্ত্রী-সহ অনেক মন্ত্রী বিভিন্ন বৈঠকে ব্যস্ত থাকবেন। তাই সরকার আগামী সপ্তাহ থেকে আলোচনার পক্ষে অনড় থাকে। সিপিএম নেতা জন ব্রিট্টাস বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে আলোচনা হোক।’’
জটিলতা কাটাতে ফের আসরে নামেন স্পিকার। বেলা ৩টেই নিজের কক্ষে ফের সব দলের সাংসদদের সঙ্গে বৈঠক করেন ওম বিড়লা। স্পিকার মমতার প্রসঙ্গ তুলে কাকলিকে বলেন, ‘‘আজ কলকাতায় বন্দেমাতরম্ প্রসঙ্গে সাত মিনিট বলেছেন মমতা। আপনি আর না করবেন না।’’
যদিও ঘটনা হল সংসদে ‘বন্দেমাতরম্’ স্লোগান দেওয়া সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আজ সরব হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সূত্রের মতে, এর পরেই স্পিকার দাবি করেন, তিনি অভিষেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনিও এতে রাজি। স্পিকারের দাবি শুনে কাকলি আলাদা করে অভিষেকের সঙ্গে কথা বলে প্রথমে ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে সবুজ সঙ্কেত দেন। শেষ পর্যন্ত দিনের চতুর্থ বিষয় উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সোমবার ‘বন্দেমাতরম্’ ও তার পরের দিন নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনা করার কথা সরকারি ভাবে জানায় সরকার। দিনের শেষে স্পষ্ট অভিষেকের হস্তক্ষেপে এসআইআর নিয়ে আলোচনার প্রশ্নে নমনীয় অবস্থান নিয়েছে তৃণমূল। ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়ে আগে আলোচনা মেনে নেওয়া নিয়ে ডেরেকের বক্তব্য, ‘‘কৌশলগত অবস্থান বদল। মূল অবস্থানের পরিবর্তন নয়।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)