Advertisement
E-Paper

থানায় এলেন আবু আয়েশ, পুলিশ হাত গুটিয়েই

অনুতপ্ত তিনি একেবারেই নন! বরং সুর চড়াচ্ছেন আরও। প্রকাশ্যে চড় মেরে জুতোপেটা করেছেন যাঁদের, সেই ডানকুনি টোল প্লাজার কর্মীদের বিরুদ্ধেই সোমবার পাল্টা অভিযোগ দায়ের করলেন তৃণমূল নেতা আবু আয়েশ মণ্ডল। অভিযোগ করলেন থানায় এসে। অথচ নিজে থেকে গেলেন অধরাই! মারধরের সিসিটিভি ফুটজে পুলিশের হাতে থাকা সত্ত্বেও। শুধু তাই নয়, আনন্দবাজারের কাছে আবু আয়েশ কার্যত স্বীকারও করে নিয়েছেন টোল প্লাজার কর্মীদের হেনস্থা করার কথা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৪
দফতরে আবু আয়েশ মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র

দফতরে আবু আয়েশ মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র

অনুতপ্ত তিনি একেবারেই নন! বরং সুর চড়াচ্ছেন আরও।

প্রকাশ্যে চড় মেরে জুতোপেটা করেছেন যাঁদের, সেই ডানকুনি টোল প্লাজার কর্মীদের বিরুদ্ধেই সোমবার পাল্টা অভিযোগ দায়ের করলেন তৃণমূল নেতা আবু আয়েশ মণ্ডল। অভিযোগ করলেন থানায় এসে। অথচ নিজে থেকে গেলেন অধরাই! মারধরের সিসিটিভি ফুটজে পুলিশের হাতে থাকা সত্ত্বেও। শুধু তাই নয়, আনন্দবাজারের কাছে আবু আয়েশ কার্যত স্বীকারও করে নিয়েছেন টোল প্লাজার কর্মীদের হেনস্থা করার কথা।

৫০ টাকা টোল চাওয়ার ‘অপরাধে’ রবিবার টোল প্লাজার কর্মীদের (যাঁদের মধ্যে আছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মীও) মারধর ও জুতোপেটার অভিযোগ উঠেছিল সংখ্যালঘু বিত্ত উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান আবু আয়েশের বিরুদ্ধে। শেষ অবধি টোল না দিয়েই বর্ধমান চলে গিয়েছিলেন তিনি। আর সোমবার বর্ধমান থেকে ডানকুনি থানা গেলেন সেই টোল প্লাজাই পেরিয়ে! লালবাতি লাগানো ছোট গাড়িতে। টোল দিলেন না এ দিনও।

রবিবার বিকেলেই আবু আয়েশের বিরুদ্ধে ডানকুনি থানায় অভিযোগ করেন টোল প্লাজার একাধিক কর্মী। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এত গুরুতর অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও এ দিন ডানকুনি থানায় অভিযোগ করতে যাওয়া ওই তৃণমূল নেতাকে পুলিশ ধরল না কেন? বিরোধী এবং টোল প্লাজার কর্মীদের একাংশের দাবি, শাসকদলের প্রভাবশালী নেতা হওয়ার সুবাদেই পুলিশ তাঁকে ধরার সাহস দেখায়নি। অথচ পুলিশের হাতে রয়েছে রবিবার দুপুরের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ। আর রয়েছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী, যাঁরা এ দিনও আবু আয়েশের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। যাঁদের সকলেই তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র সদস্য। তবু পুলিশ কেন হাত গুটিয়ে, প্রশ্নটা সোমবার দিনভর ঘুরপাক খেয়েছে টোল প্লাজার কর্মীদের মনে। তাঁরা অবশ্য হাল ছাড়ছেন না।

কেন ধরা হয়নি আবুকে, সে প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি হুগলি জেলা পুলিশের কর্তাদের কাছে। ঠিক যেমন উত্তর মেলে না, কেন খুনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অনুব্রত মণ্ডলদের ধরা তো দূর অস্ত, জেরা পর্যন্ত করার সাহস পায় না বীরভূম জেলার পুলিশ। ‘আমরা দু’তরফের অভিযোগ পেয়েছি। টোলপ্লাজার সিসিটিভি ফুটেজ বাজেয়াপ্ত করেছি।’এ কথা বলেই আপাতত হাত ঝেড়ে ফেলেছেন হুগলি পুলিশের এক পদস্থ কর্তা। তাঁর আরও দাবি, “সিসিটিভির ফুটেজ খুব অস্পষ্ট। তাই ঘটনা পরম্পরায় পুরো বিষয়টি পুলিশ খতিয়ে দেখছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।” জিজ্ঞাসাবাদ অবশ্য মারধরে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাকে করা হয়নি। বরং জেরার মুখে পড়ছেন টোল প্লাজার কর্মীরাই।

পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন লালবাতি লাগনো গাড়িতে এসে আবু আয়েশ ডানকুনি থানায় ঢোকেন। টোল প্লাজার ‘বুথ স্টাফ’ গোপাল সিংহরায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে ৫০০ টাকা চাওয়া ও তাঁকে হেনস্থা করার অভিযোগ দায়ের করেন। এবং সেই গাড়িতে চেপেই কলকাতায় এসে সাংবাদিক সম্মেলন করে তোপ দাগেন সংবাদমাধ্যম ও টোল প্লাজার কর্মীদের বিরুদ্ধেই। দাবি করলেন, ‘সব আষাঢ়ে গপ্পো!’ তাঁর অভিযোগ, “ওই টোল প্লাজায় আমায় বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড করে আটকে ৫০০ টাকা চাওয়া হয়। আমি প্রতিবাদ করে বলি, তোমরা ঘুষ নিচ্ছ? পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে। সব অভিযোগ ১০০ ভাগ গটআপ!”

কিন্তু ওঁরা তো আপনাদের সংগঠনের লোক? আবুর জবাব,“কোন সংগঠনের লোক ওঁরা, আমার ও-সব জানা নেই।”

কিন্তু জুতো দিয়ে মারধর? সিসিটিভির ফুটেজ তো পুলিশের হাতে?

খানিকটা আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে অভিযুক্ত নেতার দাবি, “মাঝেমধ্যেই ওরা আমাকে হেনস্থা করে। তবে, রবিবার ওখানে যা হয়েছে, তা ইচ্ছাকৃত কিছু নয়।” এর আগে আনন্দবাজারের প্রতিনিধির কাছে কিন্তু আবু বলেছেন, “আমাকে ওরা (প্লাজা কর্মীরা) হেনস্থা করেছে, আমিও ওদের হেনস্থা করেছি!”

আবু আয়েশের অভিযোগ শুনে অবশ্য আকাশ থেকে পড়েছেন টোল প্লাজার কর্মীরা। সেখানকার ১৫৪ জন কর্মীর সংগঠন পুরোটাই আইএনটিটিইউসি প্রভাবিত। সংগঠনের এক নেতা এ দিন বলেই দিলেন, “আমাদের সন্দেহ, দলের উচ্চ পদাধিকারী এক জনএই ঘটনায় যুক্ত বলেই পুলিশ পুরো বিষয়টি চেপে যেতে চাইছে। তবে, আমরা এই ঘটনার শেষ দেখে ছাড়ব। আবু সাহেব অন্যায় করলেন। আর এ দিনও তিনি টোল না দিয়ে লালবাতির গাড়ি নিয়ে আমাদেরই ফাঁসাতে অভিযোগ আনলেন!”

দলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের গায়ে দলেরই নেতা হাত তোলায় অস্বস্তি এড়াতে পারছেন না তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও। আবু আয়েশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এ দিন তৃণমূল ভবনেও যায় টোল প্লাজার কর্মী সংগঠনের এক প্রতিনিধি দল। তাঁরা লিখিত অভিযোগ জমা দেন শীর্ষ নেতাদের কাছে। নেতারা তাঁদের আশ্বাস দেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। পরে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিষয়টির তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিরোধীরা কিন্তু এত সহজে বিষয়টি ছাড়ছেন না। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “টোল প্লাজায় যা ঘটেছে, তা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। শাসক দলের মনোবৃত্তির পরিচয় অতীতেও বার বার পাওয়া গিয়েছে। প্রশাসনের রাজনীতিকরণ বাম জমানায় সম্পূর্ণ হয়েছিল। এখন সেটা আরও বেড়েছে।” আবু আয়েশ মণ্ডলের হাতে আক্রান্তরা তাঁরই দলের কর্মী। সে প্রসঙ্গে শমীকবাবুর কটাক্ষ, “তপন দত্ত বা সাগর ঘোষ কাদের হাতে খুন হয়েছেন? আসলে এক দিন যাঁরা নিজেদের ঘাম-রক্ত দিয়ে দেওয়ালে তৃণমূলের প্রতীক এঁকেছিলেন, তাঁরাই এখন ওই দলে অত্যাচারিত এবং প্রান্তিক। আর যাদের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রাণপণ লড়েছিলেন, সেই দলের বাহুবলীরাই এখন তৃণমূলে ঢুকে তাদের পুরনো কর্মীদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন!” হুগলির বাসিন্দা, ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য নেতা নরেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চোরের মায়ের বড় গলা! এক জন অভিযুক্ত থানায় ঢুকে পাল্টা অভিযোগ করল, আর পুলিশ কিছু করল না? আসলে তৃণমূলের শাসনে পুলিশ দলদাসে পরিণত হয়েছে।”

আবু আয়েশ টোল প্লাজার যে কর্মীর বিরুদ্ধে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন সেই গোপাল সিংহরায় (তিনিই রবিবার আবু আয়েশের গাড়ি পরীক্ষার জন্য দাঁড় করিয়েছিলেন) এ দিনও কাজে ছিলেন। গোপালবাবু বলেন, “ট্রাকচালক বা অন্য গাড়ির লোকজন এই ঘটনা ঘটালে এতটা খারাপ লাগত না। কিন্তু এক জন শিক্ষিত লোক এবং আমাদের দলের নেতা এই ঘটনা ঘটালেন বলেই খারাপ লাগছে।” তাঁর আরও বক্তব্য, “আমি ওঁর কাছে আদৌ টাকা চেয়েছিলাম কি না, সিসিটিভি ফুটেজ-ই তা জানান দেবে। তা ছাড়া আমি ১৭ বছর চাকরি করছি। এমন অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে উনিই প্রথম আনলেন। এখন নিজের অপরাধ ঢাকতে মিথ্যা বলছেন। সত্য কিন্তু চাপা যায় না!”

TMC leader dankuni toll plaza abu ayesh mondal Abu Ayesh beating toll plaza worker bjp attack state new online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy