Advertisement
E-Paper

নবদ্বীপে দোলে মাছ-মাংস খাবেন না! ‘আবেদন’ তৃণমূল পুরপ্রধানের, দলনেত্রী মমতা যদিও এমন মতের বিরোধী

ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভাস, ধর্মাচরণ— এই সমস্ত ক্ষেত্রেই বহুত্ববাদের পক্ষে বরাবর সওয়াল করে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলে এসেছেন, ‘‘যাঁর যা ইচ্ছা, তিনি তা-ই খাবেন।’’ তাঁর দলেরই এক পুরপ্রধান বিতর্কে জড়ালেন দোলে আমিষ বর্জনের কথা বলে।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫ ১৯:১৩

—ফাইল ছবি।

যাঁর যা ইচ্ছা, তিনি তা-ই খাবেন। আমিষ-নিরামিষ বিতর্কে বরাবর এই কথাই বলে এসেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার তাঁর দলেরই এক পুরপ্রধান দোলপূর্ণিমায় মাছ-মাংস না খাওয়ার ‘অনুরোধ’ করে বসলেন! এ-ও বললেন, ‘‘আমরা তো আর আইন প্রণয়ন করতে পারি না। তাই এই আবেদনকেই আইন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।’’

দেশে সমস্ত আমিষ পদই নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করে সম্প্রতি বিতর্কে জড়িয়েছিলেন আসানসোলের তৃণমূল সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হা। তাঁর দলের নেত্রী মমতা যেখানে ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভাস, ধর্মাচরণ— এই সমস্ত ক্ষেত্রেই বহুত্ববাদের পক্ষে সওয়াল করে থাকেন, সেখানে শত্রুঘ্নের ওই মন্তব্য দলীয় লাইনের ‘পরিপন্থী’ ছিল। তৃণমূল সূত্রের খবর, সাংসদের মন্তব্য মমতা যে ভাল ভাবে নেননি, তা তাঁকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল। পরে ওই মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন শত্রুঘ্ন। সেই একই বিতর্কে এ বার জড়ালেন নবদ্বীপের তৃণমূল পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা।

দোল উৎসবের প্রস্তুতিতে সম্প্রতি পুরসভার তরফে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। ওই বৈঠকে বৈষ্ণব মঠের প্রধান, বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই নবদ্বীপবাসীর উদ্দেশে দোলে মাছ-মাংস না খাওয়ার ‘আবেদন’ করেন বিমানকৃষ্ণ। তাঁর বক্তব্যের একটি ভিডিয়োও প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে পুরপ্রধানকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘আমি কোনও ধর্মকে ছোট করছি না। আমাদের হিন্দুধর্মে বিভিন্ন উৎসবে আমরা নিরামিষ খেয়ে থাকি। এটা (দোল উৎসব) চৈতন্যদেবের আবির্ভাবতিথি। এই তিথিতে এখানে চৈতন্যদেবের লক্ষ লক্ষ ভক্ত আসেন। তাঁরা অধিকাংশই নিরামিষভোজী। তাঁরা এসে এই দৃশ্যদূষণ দেখবেন। দেখবেন কেউ রাস্তার এ ধারে খাসি খাচ্ছেন, কেউ ও ধারে মুরগি খাচ্ছেন! এটা তাঁদের পক্ষে অসহনীয়। সেটা মাথায় রেখেই নবদ্বীপবাসীর কাছে পুরসভার পক্ষ থেকে আমাদের আবেদন, আগামী ১৩, ১৪ এবং ১৫ মার্চ আপনারা আমিষ ত্যাগ করে নিরামিষ খান।’’

শুধু এ বারই নয়, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালেও একই ভাবে পুরসভার পক্ষ থেকে দোলে আমিষ বর্জনের আবেদন করা হয়েছিল। বিতর্ক তখনও হয়েছিল। এ বারও একই আবেদন করে পুরপ্রধান বলেছেন, ‘‘এটি কোনও সরকারি আদেশ নয়। বরং আমাদের অতিথিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানোর জন্য একটি সহজ আবেদন। মাছ-মাংস খাওয়া তাঁদের অনুভূতিতে আঘাত করে। সেই জন্যই আমাদের আমিষ বর্জন করা উচিত।’’

নদিয়ার নবদ্বীপ চৈতন্যদেবের জন্মস্থান। মঠ-মন্দিরের শহর নবদ্বীপে সারা বছরই ভক্তদের সমাগম লেগে থাকে। বিদেশ থেকেও দলে দলে ভক্তেরা আসেন। দোলপূর্ণিমায় সেই সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যায়। ট্রেন বা লঞ্চ থেকে নেমে যে রাস্তা ধরে মঠের দিকে যেতে হয়, সেই রাস্তার দু’পাশে প্রচুর মাছ-মাংসের দোকান এবং হোটেল রয়েছে। অনেক পর্যটক সেই সব হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেন। পুরপ্রধানের মন্তব্যের পরে সেই সব হোটেলের মালিকেরা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। নবদ্বীপ স্টেশন সংলগ্ন অন্নপূর্ণা হোটেলের কর্ণধার রাজীব দত্ত বলেন, ‘‘পর্যটকদের জন্যই আমাদের পেট চলে। আমাদের আমিষ খাবারের হোটেল। পুরসভার আবেদন মেনে আমাদের সব বন্ধ রাখতে হচ্ছে। দুটো পয়সা আয় হত। সেটা এ বার আর হবে না। আমরা তো জোর করে কাউকে কিছু খেতে বলছি না। কিন্তু যাঁরা খেতে চান, তাঁদের কেন আটকানো হচ্ছে?

নবদ্বীপের পরিচিত সমাজকর্মী সুজিত চক্রবর্তীর মতে, ‘‘বাংলা উদার সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। শ্রীচৈতন্যদেব উদারতার বার্তা প্রচার করেছিলেন। তাঁর জন্মদিনকে সামনে রেখে বাংলায় এমন খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার কোনও প্রচলন নেই। উত্তর ভারতের মতো বাংলায় উৎসবে এ ভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত নয়।’’

প্রত্যাশিত ভাবেই পুরপ্রধানের অভিমতকে সমর্থন করেছে বিজেপি। রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার বলেছেন, ‘‘তৃণমূল সব সময় একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে তোষণ করে এসেছে। তবে নবদ্বীপ পুরসভার অন্তত দোলের কথা মাথায় রেখে বোধোদয় হয়েছে। তাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।’’

বস্তুত, নবরাত্রি বা শ্রাবণ মাসে মাছ-মাংস খাওয়াকে ‘মোগলদের মানসিকতা’ বলে এক বার উল্লেখ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর সেই মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা। তাঁর দাবি ছিল, বিজেপি নানা ভাবে খাওয়া-পরার মৌলিক অধিকারের উপর নিজেদের মত চাপিয়ে দিতে চাইছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘মোদী এখন বলে বেড়াচ্ছেন মাছ খাবেন না, মাংস খাবেন না, ডিম খাবেন না। তা হলে কি ব্যাঙের ছাতা খাবে? আপনি জোগাড় করে দিন। যার যা ইচ্ছা, খাবে। যে নিরামিষ ভালবাসে, সে নিরামিষ খাবে। যে আমিষ খায়, সে তা-ই খাবে। এ দেশ আমাদের সকলের। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান।’’ মোদীকে নিজের হাতে মাছ রেঁধে খাওয়ানোর কথাও বলেছিলেন মমতা। বলেছিলেন, ‘‘কেউ বিরিয়ানি ভালবাসে, কেউ চিংড়ি পটল ভালবাসে, কেউ চিংড়ির মালাইকারি ভালবাসে। মোদীবাবু, আপনি খেয়ে একটু দেখুন না স্বাদটা কেমন? খেয়ে দেখবেন? তৈরি করে দেব? কথা দিচ্ছি, কাউকে দিয়ে করাব না, নিজে রান্না করব।’’ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমিষ-নিরামিষ বিতর্কে একাধিক বার বিজেপিকে নিশানা করেছেন।

সেই দলের পুরপ্রধান দোলে আমিষ বর্জনের কথা বলায় স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়ার কথা জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের। যদিও দলের রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা সভাপতি দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘স্থানীয় মানুষের আবেগ ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে চেয়ারম্যান আবেদন করেছেন। সেটা কেউ মানতেও পারেন, না-ও পারেন। এখানে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।’’

Nabadwip Dol Controversy Mamata Banerjee Narendra Modi TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy